হাসনাত জিসান, নীল কন্ঠ ডেস্ক:
আকাশ যেমন তার রঙে রাঙায় দিগন্ত, নদী যেমন আপন ছন্দে গেয়ে যায় স্রোতের গান, তেমনি ফুটবলের সবুজ গালিচায় এক মানুষ লিখে গেছেন শিল্পের অমর কবিতা—লিওনেল মেসি। যিনি গোল করেন, কিন্তু যেন শব্দ ছুঁয়ে যায় না; যিনি ছন্দ তৈরি করেন, কিন্তু সুরের বাইরে যান না। তিনি মাঠে নামলে বল হয়ে ওঠে কলম, আর ম্যাচ হয়ে ওঠে মহাকাব্য। আলো যখন নিভে আসে, তখন কিছু মানুষ জ্বলে ওঠে আগুনের মতো। বাতাস থেমে গেলে যেমন কবি খোঁজেন নিজের ছন্দ, ফুটবলও তেমনি খুঁজে নিয়েছিল এক নীরব প্রতিভা—লিওনেল মেসি।মাঠে তাঁর উপস্থিতি যেন নিঃশব্দ ধ্রুপদী সঙ্গীত—যা বেজে চলে পায়ের তাল আর হৃদয়ের তালে। আজ তাঁর জন্মদিন।২৪ জুন, ২০২৫—তাঁর ৩৮তম জন্মবার্ষিকী।কোটি ফুটবলভক্তের হৃদয়ে এই দিনটি শুধুই জন্মবার্ষিকী নয়—এ এক আবেগ, এক অমলিন অধ্যায়।তিনি শুধু একজন ফুটবলার নন, এক যুগ, এক অনুভব, কোটি প্রাণের প্রেরণা।
লিওনেল আন্দ্রেস মেসি কুচিত্তিনি জন্মেছিলেন ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন, আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে। বাবা হোর্হে মেসি ছিলেন একটি কারখানার কর্মী, মা সেলিয়া কুচিত্তিনি হাউজকিপার। পাঁচ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব গ্র্যান্ডোলিতে খেলা শুরু করেন, সাত বছরে যোগ দেন নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজে। ছোটবেলাতেই ধরা পড়ে হরমোনজনিত গ্রোথ সমস্যার রোগ, প্রতিদিন নিয়ম করে রাত ৯টায় ইনজেকশন নিতে হতো। চিকিৎসা ব্যয় পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব না হওয়ায় আর্জেন্টিনার কোনো ক্লাব তাঁকে নিতে রাজি হয়নি। তখন ১৩ বছর বয়সে বার্সেলোনার স্কাউট হোর্জে রেক্সাচ তাঁকে সুযোগ দেন। ইতিহাসের এক অনন্য কাহিনি—মেসির প্রথম চুক্তি লেখা হয় খাবারের টিস্যুতে। সেই টিস্যুই হয়ে ওঠে বিশ্ব ফুটবলের ভাগ্যবদলের দলিল।
» ২০০৩ সালে বার্সার সিনিয়র দলে অভিষেক। ২০০৫ সালে আলবাসেতের বিপক্ষে করেন প্রথম গোল। এরপর তিনি হয়ে ওঠেন ক্লাবটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। বার্সেলোনার হয়ে মোট ৭৭৮টি ম্যাচে ৬৭২টি গোল ও ৩০৫টি অ্যাসিস্ট করেছেন। জিতেছেন ১০টি লা লিগা, ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ ৩৫টি ট্রফি। গঠন করেন নেইমার ও সুয়ারেজকে নিয়ে ‘এমএসএন’ নামক ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী ত্রয়ী। মাঠজুড়ে তাঁর উপস্থিতি মানেই ছন্দ, মানেই ফুটবলের শুদ্ধতম সৌন্দর্য।
» আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে অভিষেক ২০০৫ সালে। ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ খেলেন। শুরুটা কঠিন ছিল। কোপা আমেরিকার একাধিক ফাইনালে হেরে হতাশায় ডুবে ২০১৬ সালে অবসর ঘোষণা করেন। পরে ফিরে এসে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জয় করে বহু বছরের খরা কাটান। ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে তিনি আর্জেন্টিনাকে করেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। খেলেন প্রতিটি ম্যাচে, গোল করেন সাতটি, অ্যাসিস্ট তিনটি—একটি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ অবদানের এক অনন্য রেকর্ড। ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুইটি বিশ্বকাপে (২০১৪, ২০২২) গোল্ডেন বল জিতেছেন। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ১৮০টিরও বেশি ম্যাচ, করেছেন ১০৬টির বেশি গোল—আর্জেন্টিনার ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
» ২০২১ সালে বার্সেলোনা আর্থিক সংকটে পড়লে মেসি ক্লাব ছাড়তে বাধ্য হন। যোগ দেন ফ্রান্সের পিএসজিতে। সেখানে ২ মৌসুমে জেতেন লিগ শিরোপা ও কাপ। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেন ইতিহাসের অন্যতম আর্থিক চুক্তিতে। সেই চুক্তির আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাঁর উপস্থিতিতে মেজর লিগ সকারে দর্শক সংখ্যা, সম্প্রচার অধিকার, এবং ক্লাব মার্কেটিং-এ বিপ্লব ঘটে। বিশ্বের মিডিয়া এটিকে নাম দেয়—”The Messi Effect”। তাঁর আসার পর পরই অ্যাপল টিভি প্লাসে তাঁর জীবনভিত্তিক ডকুমেন্টারি প্রকাশিত হয়।
» বর্তমানে মেসির ক্লাব ক্যারিয়ারে মোট গোলসংখ্যা ৮২৬ ছাড়িয়েছে। খেলেছেন ১০২০টিরও বেশি ম্যাচ।’ফিফা’ গেমে টানা ১৪ বছর ধরে সবচেয়ে বেশি বাছাইকৃত খেলোয়াড়। সর্বমোট ৮টি ব্যালন ডি’অর, ৬টি ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু, ৩টি ফিফা দ্য বেস্ট পুরস্কার, এবং দুই বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল পাওয়া একমাত্র খেলোয়াড়। তাঁর উপস্থিতি কেবল মাঠে সীমাবদ্ধ নয়—সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং–এর ক্ষেত্রেও মেসি হয়ে উঠেছেন এক মডেল।ইনস্টাগ্রামে তাঁর বিশ্বকাপ হাতে তোলা ছবিটি বিশ্বের সর্বোচ্চ লাইকপ্রাপ্ত ছবি (৭ কোটি+)। ‘ফোর্বস’ সাময়িকীর ২০২৪ সালের তালিকায় তিনি ছিলেন বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ আয় করা ক্রীড়াবিদ।
» মেসির দাম্পত্য সঙ্গীর নাম আন্তোনেলা রোকুজ্জো। শৈশবের প্রেমিকা। তাঁদের তিন সন্তান—তিয়াগো, মাতেও ও চিরো। বড় ছেলে তিয়াগো ইতোমধ্যেই ইন্টার মায়ামির যুব দলে খেলছেন। মেসি পরিবারের জন্য সময় বের করেন সবসময়। মাঠের বাইরে নম্র, শান্ত, অবসরে থাকেন পরিবার ও বইয়ের সঙ্গে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘লিও মেসি ফাউন্ডেশন’, যা শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় কাজ করে। রোসারিও শহরে তাঁর নামে একটি ফুটবল একাডেমি রয়েছে, যেখানে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
»বিশ্বজুড়ে মেসি শুধু একজন খেলোয়াড় নন—একটি নাম, যা শিশুদের অনুপ্রেরণা, তরুণদের স্বপ্ন, প্রবীণদের শ্রদ্ধা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অন্তত ২০টির বেশি গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে তাঁর নেতৃত্ব ও মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে। আর্জেন্টিনার দূতাবাসগুলো ২৪ জুন উদ্যাপন করে “মেসি ডে” নামে—যেখানে শিশুদের ফুটবল প্রতিযোগিতা ও তাঁর জীবনীভিত্তিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।মেসির প্রিয় খাবার মায়ের বানানো মিলানেসা। তিনি সবসময় মাঠে নামার সময় বাম পা দিয়ে প্রবেশ করেন। জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত হিসেবে মনে রাখেন ২০২২ বিশ্বকাপ ফাইনালে দলের হাতে ট্রফি তোলার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আর সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত ছিল ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা ফাইনালে টাইব্রেকারে হারের পর চোখের জলে ডুবে থাকা রাত।
» যেমন আকাশ আঁকে আলোয় তারার ছবি,
তেমনই মেসি লেখেন ফুটবলে হৃদয়ের কবিতা।পায়ের ছোঁয়ায় ছড়িয়ে দেন নীরব বিস্ময়,আর প্রতিটি ছন্দে জেগে ওঠে অনন্ত সম্ভাবনা।তিনি গোল করেন, যেন দিগন্তে এক নতুন ভোর জাগে,তিনি হাঁটেন, যেন মাঠ হয়ে ওঠে মুগ্ধ শ্রোতার গান।জন্মদিন তাঁর, অথচ উদ্যাপন সবার—কারণ তিনি শুধু খেলেন না,
তিনি স্বপ্ন দেখান, পথ দেখান, ভালোবাসা ছড়িয়ে দেন নিঃশব্দ বাতাসে।লিওনেল মেসি—একটি নাম নয়,
এ এক অনুভব, এক অনুপ্রেরণা, এক অমর সুর।
আজ তাঁর ৩৮তম জন্মদিনে গোটা বিশ্ব যেভাবে ভালোবাসায় সিক্ত করছে তাঁকে, তা প্রমাণ করে তিনি কেবল একজন ফুটবলার নন—এক জীবন্ত কিংবদন্তি, যার নাম লেখা থাকবে চিরকাল ফুটবলের কাব্যে।