নিউজ ডেস্ক:
আমরা পাংখোপাড়ায় যাই কোনো এক ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। শাহবাগে তখন স্লোগানের উত্তাপ। প্রকৃতিতে শীত শীত ভাবটা তখনো পুরোপুরি যায়নি।
রাঙামাটিতে লেকের ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বিলাইছড়ি উপজেলার দিকে যাত্রা। পুরোটা যেতে হয় না। বিলাইছড়ি উপজেলা বাজারের বেশ খানিক আগেই রাইখং নদীর বাঁ পাড়ে পাংখোপাড়া।
যাত্রাপথ লম্বা। ঘণ্টা চারেক লাগে। দুপুরবেলা রাঙামাটি থেকে রওনা দিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। পথে শুরুতে কিছুক্ষণ লেকের স্থির পানি। তাতে খানিক পরপরই বাঁশের ভেলা ভেসে যায়। নৌকা ঘণ্টা দুয়েক উজানে গেলে লেকের বিস্তীর্ণ জলরাশি সংকীর্ণ হয়ে রূপ নেয় নদীতে। সেই নদীতে স্রোত নেই। পানি স্থির। ফলে নদীটাকে একটা কালচে ভেলভেটের মতো লাগে। দূর থেকে যেসব নৌকা আমাদের দিকে ভেসে আসতে দেখি, মনে হয় একটা স্থিতিস্থাপক ভেলভেটের চাদরের ওপর দিয়ে সেগুলো গড়িয়ে আসছে। ঢেউগুলো যেন কুঁচকে যাওয়া কাপড়ের ভাঁজ। তুলনাটা পুরোপুরি মিলল না। কেননা নদীটা আবার আয়নার মতো প্রতিফলনময়, ঝকঝকে। পুরো আকাশটা নদীর ওপর উল্টে আছে। তার মানে আয়নার মতো বিম্ববতী একটা ভেলভেটের নদী। বড় জটিল।
কিছুদূর গিয়ে একটা বিজিবির চেকপোস্ট। সেটা পেরোলে সামনে হঠাৎ করে ভূদৃশ্য বদলে যায়। একটা উপত্যকায় এসে পড়েছি। টিলাগুলো বহুদূরে সরে গিয়ে বিশাল একটা ফাঁকা প্রান্তর তৈরি করেছে। দূর দিগন্তে উঁচু উঁচু পাহাড়। পোড়া বাদামি শরীর পাহাড়গুলোর। আলো কমে আসতে থাকায় সবকিছুতে একটা সেপিয়া রং ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা যেন একটা অতীতকালের ছবির ফ্রেমের মধ্যে ভুলে ঢুকে পড়েছি।
বিলাইছড়ি এমনিতে খুব প্রত্যন্ত এলাকা। পাংখোপাড়া আরও প্রত্যন্ত। পৃথিবীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গ্রাম যেন। সেই গ্রামের ঘাটে নেমে দেখি সন্ধ্যার আলোয় সামনে একটা স্কুলের মাঠ। মাঠের ওপারে টানা লম্বা স্কুলঘর। ক্লাস টেন পর্যন্ত স্কুল। পাংখো বা পাংখোয়া জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা তাতে পড়ে। বাংলা ভাষায় পড়ে। পাংখোয়াদের নিজেদের ভাষা আছে বটে। লিপি নেই।স্কুলের একপাশে পাকা দোতলা অফিস ভবন। সেই ভবনের দোতলায় দুটি কক্ষে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত।
পুরো তল্লাটে বিদ্যুৎ নেই। অমাবস্যার রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বারান্দায় দাঁড়ালে সামনের দু-হাত দূরের নদীও দেখা যায় না। শুধু একটা-দুটো অদৃশ্য নৌকা ভৌতিক আওয়াজ তুলে কখনো বাঁ থেকে ডানে, কখনো ডান থেকে বাঁয়ে চলে যায়। একটা সময় সন্দেহ হয়, কোনো নৌকা হয়তো যাচ্ছে না, শুধু আওয়াজগুলো যাচ্ছে। বিদ্যুৎমুক্ত না হলে বোঝা যায় না, অন্ধকার কতটা সন্দেহবাতিক।
স্কুলঘরের পেছনে পাহাড় উঠে গেছে। সকালে অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে সেই পাহাড়ে উঠি। পাশাপাশি লাগোয়া কয়েকটি পাহাড়। সেগুলোয় পাংখোদের গ্রাম। শুনেছি পাংখোরা নাকি সমতলভূমিতে থাকতে পারে না। ছড়ানো-ছিটানো ৫০ থেকে ৬০টি বসতবাড়ি। পুরো পার্বত্য অঞ্চলেই সংখ্যালঘু পার্বত্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পাংখোরা আরও সংখ্যালঘু। সব মিলিয়ে হাজার তিনেক জনসংখ্যা হবে। তাও আবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পার্বত্য জেলাগুলোর বিভিন্ন উপজেলায়। বিলাইছড়ির এই পাংখোপাড়ার বসতিটি সে হিসেবে একটি বড় পাংখোবসতিই বলতে হবে।
পাংখো বা পাংখোয়ারা ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। তবে ধর্মকর্মে খুব যে মতি আছে, এমন মনে হলো না। পাহাড়ের ওপরে গ্রামের একধারে একটা গির্জা চোখে পড়ল বটে, কিন্তু সেটির ভাঙা কাচের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি ভেতরের বেঞ্চগুলোতে পুরু ধুলোর স্তর। চত্বরে উল্টে থাকা একটা মড়া গাছের গুঁড়িতে বসে থেকে দেখলাম, গির্জা প্রাঙ্গণ সুনসান।
আদিতে এরা প্রকৃতিপূজারি ছিল। লুসাই পর্বতের জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এদের অনেক মিল। পৌরাণিক কাহিনিগুলোতেও বেশ মিল আছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে এদের ধর্মান্তর ঘটেছে। এ কারণে বাইবেলে বর্ণিত বিভিন্ন নাম দিয়ে নাম রাখার চল আছে। যেমন আব্রাহাম, জেমস, এন্ড্রু, মেরি, মিখাইল। আবার লেখাপড়ার সূত্রে বাংলার সংস্পর্শে আসায় নামের মধ্যে অনেক বাংলা শব্দও ঢুকে পড়েছে। যেমন দিলীপ, খোকা ইত্যাদি।
পাংখোদের মূল জাতিগত স্রোতটি সীমান্তের ওপারে মিজোরামে। এরা কবে, কীভাবে এখানে এসেছে, ইতিহাস জানি না। গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকলেও ইদানীং কিছু সোলার প্যানেল বসেছে। তাতে দুয়েকটি বাড়িতে টিমটিম করে বাতি জ্বলে। পাংখো গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানটিতে বিদ্যুতের বাতি জ্বলে। সেখানে প্রাণ কোম্পানির চানাচুর, চিপসের প্যাকেট ঝুলে আছে বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগচিহ্ন হিসেবে। পাহাড়ের ওপরে পানি ওঠে না। পাংখো মেয়েরা কলসে করে টিউবওয়েলের পানি নিয়ে যান। নদীর ঘাটে স্কুলের টিউবওয়েল। সেটিই পানির উৎস।
পাংখো নারীরা কাপড় বোনেন। পুরুষেরা করেন জুমচাষ। এর বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে তেমন কিছু নেই। ফলে যাতায়াতও সীমিত। কেরোসিন শেষ হলে বা লবণ কিনতে দোকানের কারবারিকে যেতে হয় বিলাইছড়ির বাজারে। ওইটুকুই।
সামনের নদী বেয়ে সে কারণে সারা দিনে একটি কি দুটি নৌকা যায়। নতুবা গ্রামটা নিশ্চল, নিশ্চুপ। শীতকালে গাছের পাতাও খুব একটা নড়ে না। পাংখোপাড়ায় পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা স্থির।
ত্রিসীমানায় মোবাইল ফোনের টাওয়ার নেই। ফলে কোনো নেটওয়ার্কও নেই। খুব চেষ্টাচরিত্র করলে একটা ফোন কোম্পানির ক্ষীণ নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
দুপুরবেলা আমরা রাইখং নদীতে নামি গোসল করতে। হ্রদের মতো স্থির পানি। স্রোত না থাকায় প্রচুর পরিমাণে জলজ উদ্ভিদ পানির তলায়। তাদের রাবারের মতো স্পর্শে শরীর শিরশির করে ওঠে। পানিতে শেওলার একটা আস্তরণ। কাপ্তাই বাঁধের প্রভাব। দু-তিন পা হেঁটে গেলেই পানির গভীরতা অতলে নেমে গেছে। আমি গজ দুয়েক সাঁতরে তারপর ডুব দিয়ে তলা স্পর্শ করার চেষ্টা করি। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তবু তল পাওয়া যায় না। ক্ষুদ্র অপ্রশস্ত নদী। কিন্তু তলহীন। বোঝা যায়, নদীর পাড় আসলে একটা পাহাড়ের ঢাল।
আমি সাঁতার ভালো জানি না। কোনোরকমে শরীরটাকে পানির ওপর ভাসিয়ে রাখা, এটুকুই। ডুবসাঁতার, চিৎসাঁতারের কেরামতি জানি না। তার ওপর একবার ডুব দিয়ে তল না পাওয়ায় গা ছমছম করতে থাকে। মনে হয় ভারী শরীরটাকে কেউ নিচের দিকে টানছে। নিচে রাবারের মতো পিচ্ছিল একটা বাগানের মধ্যে। মনে হয়, পা থিয়ান আর খোজিং নামে পাংখোদের দুই পরিত্যক্ত দেবতা মনে গোপন কোনো রোষ নিয়ে সেই বাগানে লুকিয়ে আছেন। পূজিত না হওয়ার রোষ।
নদীতে অনেকক্ষণ ধরে গোসল সারব ভেবে নেমেছিলাম। কিন্তু কেউই বেশিক্ষণ নদীতে থাকি না। উঠে এসে স্কুলের টিউবওয়েলে আরেক দফা গোসল।
বিকেলে কোনো কাজ না থাকায় আমরা ঘুরতে বেরোই। নৌকা নিয়ে আরও উজানে। কে যেন বলল, একটা পাথুরে পাহাড় আছে। কাছেই। কিন্তু নৌকা নিয়ে বেরিয়ে দেখি সেটা অত কাছে নয়। বিলাইছড়ি উপজেলা চত্বর পেরিয়ে আরও বেশ খানিকটা গেলে নির্জন নদীর পাড় থেকে দুম করে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়। অনেক উঁচুতে বিশালদেহী গাছগুলোকে মনে হয় বনসাই। একটা প্লেন উড়ে গেছে হয়তো খানিক আগে। একটা সাদা ধোঁয়ার রেখা আকাশ এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলে গেছে। এদিকটায় জনবসতি একেবারেই বিরল। মাঝেমধ্যে তঞ্চঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর দু–একটি গ্রাম।
রাতে অফিস ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটানা ঝিল্লিরব শুনতে শুনতে একটা চিন্তা মাথায় আসে: অনেক ওপরে অন্ধকারে পাংখোদের যে ঘরবাড়ি, যে সমাজ—সেখানে ঈশ্বর প্রবেশ করেছেন নিচ থেকে। সাধারণত ঈশ্বর ওপর থেকেই নামেন। পাহাড়ে সেটা ব্যতিক্রম।
আমরা যেদিন ফিরি, সেদিন খুব ভোরে রওনা দিয়েছি। ঘাট থেকে নৌকা ছাড়লে দেখি কালো পানির তলদেশ থেকে এঁকেবেঁকে উঠে আসছে সাদা কুয়াশা। রাইখং যেন কোনো পৌরাণিক নদী। কিছুদূর গিয়ে সেটা খাড়া নেমে যাবে জলপ্রপাতের মতো। কেননা পৃথিবী গোলাকার নয়। আমরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসি। সেটা সকালের ঠান্ডা বাতাসের কারণেও হতে পারে।