মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাজ হলো দেশকে মাদকমুক্ত করা। আর মাদকাসক্তি এক ভয়াবহ মরণব্যাধি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে সকল সমস্যা বিদ্যমান তার একটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে মাদকের ভয়াল থাবা।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলায় সহকারী পরিচালক হিসেবে মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান যোগদান করেন। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তাকে একই কর্মস্থলে উপ-পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। যোগদানের পর থেকে আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকে চাঁদপুরের পুরনো সব দৃশ্যপট। চাঁদপুরের ৮ উপজেলায় এখন শুধু মাদক নির্মূলের পথেই নয় বরং মাদক প্রবণতার অপরাধ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার প্রচেষ্টায় আইন শৃঙ্খলারও অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়ে সর্বত্র যেন শান্তির সুবাতাস বইছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়
গেল ১৮ মাসে ২ হাজার ৩৫২টি অভিযানে ২২৪০ পিছ ইয়াবা, ১৮৪ কেজি গাঁজা, ১৭ বোতল বিদেশী মদ, ৩৩ হাজার ৩৮০ নগদ অর্থ,
১৭৬ জন মাদক কারবারীকে গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে ১৬৭টি মামলা দায়ের করতে সক্ষম হয়েছেন। এর সাথে মাদক পরিবহনের দায়ে ২টি প্রাইভেট কার, ১টি মিনি পিকআপ, ১টি মোটর সাইকেল এবং ১৭ টি মোবাইল সেট এবং মাদকের সাথে ৪৮ টি ইমিটেশন চেইন, ৫৯ টি কানের দুল ও ১০টি চোখের কাজল পেন্সিল জব্দ করা হয়েছে।
সোমবার (৩ মার্চ) এক সাক্ষাৎকারে মাদক নির্মূলের সাফল্যে চাঁদপুরের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছি বলেই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে। ‘কেউ অপরাধ করলে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। মাদক সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়। সারা পৃথবীতে এখন মাদক একটি বড় সমস্যা। মাদকে আসক্তির ফলে ধীরে ধীরে একটি সম্ভাবনাময় জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। উঠতি বয়সের তরুণেরা, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মেয়েরাও কৌতূহলবশত বা ঠুনকো কারণে মাদকের ছোবলে জড়িয়ে পড়ছেন। নিয়মিত খেলাধুলা, শরীরচর্চা ও বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে এর থেকে দূরে থাকা সম্ভব।কেবলমাত্র আইন প্রয়োগ করে নয়, মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও ব্যক্তি পর্যায়ে শক্ত মনোবল।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বলেন, সাময়িক আনন্দ লাভের জন্য বা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল হয়নি বা পরিবারে বাবা-মায়ের ঝগড়া-বিবাদ—এসব থেকে মাদকের প্রতি প্রায়শই আসক্তি তৈরি হয়। প্রথমে এটা মানসিক চাহিদা তৈরি করে। তারপর শারীরিক চাহিদার দিকে ঝুঁকতে থাকে এবং একপর্যায়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এ সময় বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের বর্ণনা দিয়ে প্রতিটির কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হয় মর্মে জানান তিনি। তিনি বলেন, সুচিকিৎসা ও ভালোবাসার মাধ্যমে যে কাউকে মাদক থেকে মুক্ত করা সম্ভব।
মাদকাসক্তির ভয়াবহতা নিয়ে দেশজুড়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। মাদক এখন গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে তাই সকল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার পাশাপাশি সামাজিকভাবে একে মোকবেলা করা জরুরি। পাড়া–মহল্লা থেকে সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে মাদকের বিস্তৃতি রোধ করা যাবে না। মাদকাসক্তির ফলে মানুষের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ,বেড়ে যায়। এছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, অতিরিক্ত ঘুম সহ নানা ধরণের মানসিক সমস্যা তৈরী হয়। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, একবার আসক্ত হয়ে পড়লে তাকে মাদকের সর্বনাশা ছোবল থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এ ব্যাপারে পরিবারকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। একটি পরিবারে বা সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিই যথেষ্ট। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, পারিবারিকসহ নানা ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। শারীরিক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে—মুখমণ্ডল ফুলে যাওয়া, হঠাৎ চোখে কম দেখা, মুখ ও নাক লাল হওয়া, যৌনশক্তি কমে যাওয়া, মুখমণ্ডলসহ সারা শরীরে কালশিরে পড়া, হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, বুক ও ফুসফুস নষ্ট হওয়া, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, চর্ম ও যৌন রোগ বৃদ্ধি পাওয়া, সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি, স্মৃতিশক্তির কোষ ধ্বংস করা। মাদক গ্রহণে শারীরিকভাবে নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেমন—অনিয়মিত মাসিক, জরায়ুর বিভিন্ন প্রকার রোগ, নারীর প্রজননক্ষমতা হ্রাস পাওয়াসহ বিভিন্ন যৌনরোগ দেখা দেয়। সম্প্রতি মাদকাসক্তদের মধ্যে এইডস দেখা দিচ্ছে বলে মনে করেন চিকিসৎকরা। মানসিক ক্ষতির একটা বড় রূপ রয়েছে, যা সব সময় বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয় যেমন—পাগলামি করা, মাথা ঘোরা ও খিটখিটে মেজাজ, অলসতা ও উদ্বেগ, হতাশাগ্রস্ত হওয়া, স্নেহ-ভালোবাসা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
উপপরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাদকাসক্তির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে। কারণ যে পরিবারে মাদকাসক্ত ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সে পরিবারে কোনো সুখ-শান্তি থাকে না। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের অলংকার ও টাকা-পয়সা চুরি করে আর সেটা না পারলে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে জোর করে অস্ত্র দেখিয়ে অর্থ নিয়ে তার চাহিদা মেটায়। সমাজে চলে চরম বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। বর্তমানে দেশের শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।