নিউজ ডেস্ক:
জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জেএমবির পাঁচ সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন রংপুরের বিশেষ জজ আদালত।মঙ্গলবার ছয় আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা পাঁচ আসামির উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ বিচারকক্ষে রায় ঘোষণা করেন আদালতের বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার।
রায়কে ঘিরে আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সকাল সোয়া নয়টায় কারাগারে থাকা পাঁচ আসামিকে আদালতে আনা হয়। সাড়ে নয়টায় রায় পড়া শুরু করেন বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার। সোয়া এগারোটায় ৬২ পৃষ্ঠার রায় পড়া শেষে রায় ঘোষণা করেন তিনি।
সংঘবদ্ধ হয়ে একই উদ্দেশ্যে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পশুয়া টাঙ্গাইলপাড়া এলাকার জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মন্ত্রী (৩৩), একই এলাকার জেএমবি সদস্য ইছাহাক আলী (৩৪), লিটন মিয়া (৩২), গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়ার চর এলাকার সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুল (৩০) এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মকর রামাল্লী এলাকার আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লবের (৩১) বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এছাড়া প্রত্যেক আসামির ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করেন আদালত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব পলাতক রয়েছেন। তিনি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক ইব্রাহীম কবীর জানান, আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব গত বছরের জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত।
এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় কারাগারে আটক জেএমবি সদস্য আবু সাঈদকে বেকসুর খালাস দেন বিচারক।
তবে আবু সাঈদ কাউনিয়া উপজেলায় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা এবং রংপুরের বাহাই নেতা রুহুল আমীনকে গুলি করে হত্যা চেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভূক্ত আসামী। কোনিও হত্যা মামলায় আবু সাঈদ খালাস পেলেও আপাতত তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা।
রায় ঘোষণার পর বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার বলেন,দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করাই ছিল বিদেশী নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার মূল উদ্দেশ্য। দেশের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অপরাধ করার জন্য পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য বলে আমি মনে করি।
এ মামলার অভিযোগপত্রে আরও দুজনের নাম ছিল। তাদের মধ্যে পলাতক জেএমবির সদস্য সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল গত ৫ জানুয়ারি রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এবং নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে হাসান গত বছরের ২ অগাস্ট ভোরে রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
দণ্ডপ্রাপ্ত মাসুদ রান ওরফে মন্ত্রী, ইছাহাক আলী, লিটন মিয়া, সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুল কাউনিয়া উপজেলায় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা এবং বাহাই নেতা রুহুল আমীনকে গুলি করে হত্যা চেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভূক্ত আসামি। আর আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব বাহাই নেতা হত্যা চেষ্টা মামলার অভিযোগ পত্রভুক্ত আসামি।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা বলেন,আমরা প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। এ রায়ের মাধ্যমে অপর জঙ্গিরা ধর্মের নামে মানুষ হত্যার মত অপরাধ থেকে বিরত থাকবেন। আসামি পক্ষের আইনজীবী আবুল হোসেন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ন্যায্য বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
আসামিদের পরিবার যা বললেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাসুদ রানা ওরফে মন্ত্রীর স্ত্রী আলেমা বেগম বলেন, অন্যায়ভাবে আমার স্বামীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে কোনোদিন জড়িত ছিলেন না। ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা শিগগিরই উচ্চ আদালতে আপিল করব। একই কথা বলেন মাসুদ রানার বড় বোন হনুফা খাতুন। তবে অন্য আসামিদের পরিবারের কেই কথা বলতে রাজি হননি।
বিচারের ১৭ মাস, ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সকালে রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়ার ভাড়া বাড়ি থেকে রিকশায় করে কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে ঘাসের খামারে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন ৬৬ বছর বয়সী হোশি কোনিও। ওই দিনই কাউনিয়া থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী গত বছরের ৩ জুলাই জেএমবির আট সদস্যের বিরুদ্ধে রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে মামলাটি বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ৬০ কার্যদিবসে ৫৭জন সাক্ষির মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্যদিয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। দুই সাক্ষি ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় আদালত সাক্ষ্য গ্রহণ শেষের ঘোষণা দেন। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি আসামী সাখাওয়াতের পক্ষে একজন সাফাই সাক্ষি দেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের জন্য দিন ঠিক করে দেন বিচারক।
কোনিওকে হত্যার পরিকল্পনা হয় দুই মাস ধরে: মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বরাতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা বলেন, রংপুর নগরীর নুরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে আসামিরা দুই মাস ধরে হোশি কোনিওকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। আসামিরা ২০১৫ সালের ২ অগস্ট নূরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাসের পাশাপাশি একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কেনেন। অটোরিকশায় করে তারা কোনিওর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন। কোনিওকে প্রথম গুলি করেন মাসুদ রানা। গুলিটা কোনিওর গলায় লাগে। পরে মাসুদের সঙ্গী সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল কোনিওর বুকে ও হাতে গুলি করেন। এতে ঘটনাস্থলেই কোনিও মারা যান।
ভালো লোক ছিলেন কোনিও: রংপুর নগরীর মুন্সীপাড়ার জাকারিয়া বালার জাপান প্রবাসী ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে ২০১১ সাল থেকে রংপুরে যাতায়াত শুরু করেন কোনিও। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ মে রংপুরে এসে জাকারিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন কোনিও। সেখানে থেকে কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে জাপানি কয়েল ঘাসের খামার করছিলেন কোনিও। আলুটারি গ্রামের মানুষ তাকে নিপাট ভদ্রলোক বলেই জানত। কারও সাথে দেখা হলে হেসে হেসে কথা বলতেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় সালাম দিতেন, কেউ সালাম দিলে তার জবাবও দিতেন।
কে এই কোনিও: উত্তর-পূর্ব জাপানের ইওয়াতে জেলার অধিবাসি কোনিও। সেখানে লেখাপড়া শেষে চলে আসেন তোচিগি শহরে। সেখানেই থাকতেন তিনি। কোনিও বিয়ে করেননি। তার বাবা-মা জীবিত নেই। ভাই-বোন আছেন কিনা সেটা জানা যায়নি বলে জানান কোনিও যে ভাড়িতে থাকতেন, তার মালিক জাকারিয়া বলে।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কোনিও: নিহত হওয়ার আড়াই মাস আগে ১৫ জুলাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া নাম নিয়েছিলেন কোনিও। যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ি সংলগ্ন মুন্সিপাড়া কাদেরিয়া জামে মসজিদের ইমাম সিদ্দিক হোসেন জানান, তার কাছেই কলেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কোনিও। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। ধর্মীয় বই পড়তেন।
রংপুরেই শেষ ঘুম: নিহত হওয়ার পর জাপান দূতাবাসের অনুরোধে ১২ অক্টোবর গভীর রাতে মুন্সিপাড়া কবরস্থানেই কোনিওকে দাফন করে স্থানীয় প্রশাসন। কবরস্থানের লাশ দাফনের রেজিস্ট্রারেও গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া নামেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।