ব্যস্ত জীবনের ভিড়ে আমরা যেন একেকজন ছুটে চলা যন্ত্র। প্রতিদিন কাজ, দায়িত্ব আর চাপ সামলে চলতে গিয়ে একসময় নিজেকেই হারিয়ে ফেলি। কাজ থামে না, বিশ্রামও যেন বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এই বিরামহীন ছুটে চলাই অনেক সময় আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।
সাফল্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা কি এমন কিছু অভ্যাস গড়ে তুলছি, যা আমাদের ভেতরের শক্তিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে? ক্লান্ত মন, ভারী শরীর, অপূর্ণ কাজ আর অসন্তুষ্টি-এই চক্রে আটকে পড়ার আগেই দরকার নিজেকে বোঝা, নিজের যত্ন নেওয়া।
এই লেখা ঠিক সেই জায়গাতেই আলোকপাত করবে-কেন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, কোথায় আমাদের ভুল, এবং কীভাবে শক্তি সঞ্চয় করে আরও সচেতনভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
১. শরীর যখন বিশ্রাম চায়, আপনি বলছেন ‘না’!
বন্ধুদের পার্টি, সঙ্গীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, অথবা অফিসের জরুরি কাজ, সবকিছুর ভিড়ে আমরা প্রায়শই শরীরের চাহিদাকে উপেক্ষা করি। রাত জেগে পার্টি বা অফিসের কাজ সারার পরদিন শরীর কতটা কর্মক্ষম থাকবে, তা নিয়ে ভাবি না। শরীর যখন গভীর ঘুম ও বিশ্রাম চায়, তখন আমরা বেড়ানোর পরিকল্পনা করি। দিনের পর দিন শরীরের এই স্বাভাবিক চাহিদাগুলোকে অগ্রাহ্য করলে তা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ক্লান্তিও বাড়িয়ে তোলে। সারাদিন সতেজ থাকতে হলে শরীরের ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
২. নিজেকে কি অসীম ক্ষমতার অধিকারী ভাবছেন?
সংসার, সন্তান, অফিস, ব্যক্তিজীবন – একসঙ্গে এতগুলো দিক সামলাতে গিয়ে অনেকেই নিজেকে ‘সুপারহিউম্যান’ ভাবেন। একবারে একাধিক কাজ করার প্রবণতা আমাদের মধ্যে জেঁকে বসেছে। এই ট্যাব দেখছি, তো পরক্ষণেই মেসেজ পাঠাচ্ছি, আবার ল্যাপটপে অফিসের জরুরি তথ্য খুঁজছি। মাল্টিটাস্কিংয়ের এই প্রবণতা আসলে মস্তিষ্কের ওপর অনেক বেশি চাপ ফেলে। কারণ, প্রতিটি নতুন কাজে মস্তিষ্ককে পুনরায় মূল্যায়ন করতে হয়, যা প্রচুর শক্তি ক্ষয় করে। এর চেয়ে বরং এক সময়ে একটি কাজ মনোযোগ দিয়ে করলে তা আরও কার্যকর এবং কম ক্লান্তিকর হতে পারে।
৩. আপনার স্নায়ু কি বিশ্রাম পাচ্ছে?
দিনের শেষে যখন ঘুমিয়ে পড়ার কথা, তখনো আমরা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রল করছি, চ্যাট করছি, সিনেমা দেখছি। এতে হয়ত সাময়িকভাবে মন ভালো লাগছে, কিন্তু আপনার স্নায়ুতন্ত্র কি আদৌ বিশ্রাম পাচ্ছে? দিনভর চোখ ও মস্তিষ্ক সমান তালে কাজ করে। বিনোদন বা গল্প-গুজবের আড়ালে আমাদের স্নায়ু বিশ্রাম না পেয়ে বরং আরও বেশি উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। এই অতিরিক্ত উদ্দীপনা গভীর ঘুমের পথে বাধা সৃষ্টি করে, যা দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তি বাড়ায়।
৪. অন্যের আবেগকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজেকে অবহেলা করছেন কি?
অন্যের প্রতি সহানুভূতি দেখানো ভালো, কিন্তু নিজের অনুভূতির প্রতি অবিচার করা মারাত্মক ভুল হতে পারে। অন্যের আবেগকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে যদি নিজের মনের কথা চেপে রাখেন, তাহলে তা আপনার মানসিক শক্তি ক্ষয় করে। অনেকটা মোবাইলের ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকা অ্যাপের মতো – যা আপনি খেয়াল না করলেও আপনার ফোনের চার্জ শেষ করতে থাকে। নিজের অনুভূতিগুলোকে সম্মান না করলে মানসিক চাপ বাড়ে, যা ক্লান্তি ও হতাশার জন্ম দেয়।
৫. ঘুম ভাঙতেই ফোন হাতে?
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আড়মোড়া ভাঙার আগেই আপনার চোখ কি ফোনে চলে যায়? ক্রমাগত সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করা, দুঃখের খবর পড়া বা নোটিফিকেশন দেখতে দেখতেও কিন্তু স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে। দিনের শুরুতেই এই ডিজিটাল ব্যস্ততা মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে তোলে, যা সারা দিনের মেজাজ ও কর্মক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর বদলে ঘুম থেকে উঠে শান্তভাবে বসুন, গভীর শ্বাস নিন, এক গ্লাস পানি পান করুন এবং দিনের পরিকল্পনা ভেবে নিন। এই ছোট অভ্যাসগুলো আপনার সকালকে আরও সতেজ ও কর্মঠ করে তুলতে পারে। তাই অভ্যাসগুলো ছাড়তে হবে।
সাফল্যের পথে চলার আগে নিজের শরীর, মন ও শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করুন। কারণ, ক্লান্ত শরীর-মন আপনাকে টেনে নামাবে। শক্তি সঞ্চয় করে এগিয়ে যাওয়াই হোক নতুন অভ্যাস।