যুদ্ধ বিরতি চুক্তি ভেঙ্গে দ্বিতীয় দফা গাজায় সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে আবারো জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির মুখে পড়েছে গাজার ২০ লাখ বাসিন্দা। যুদ্ধের ভয়াবহতা গাজার নারীদের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে। বাস্তুচ্যুতি, ধ্বংস ও স্বজন হারানোর বেদনার পাশাপাশি নারীদের দেহে বাসা বাঁধছে নানা ধরনের রোগ-ব্যধি। বিশেষ করে গাজার প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন নারী এন্ডোমেট্রিওসিস, ফাইব্রয়েড, সিস্ট ও পিসিওএসের মতো স্ত্রীরোগের যন্ত্রণা সহ্য করছে। এজন্য জাতিসংঘ এই যুদ্ধকে ‘নারী স্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আখ্যা দিয়েছে।
গত মার্চের শুরু থেকে গাজায় কোনো ধরনের চিকিত্সা উপকরণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরাইল। ফলে এন্ডোমেট্রিওসিস, ফাইব্রয়েড ও পিসিওএস-তে আক্রান্ত নারীরা যেসব ব্যথানাশক ও ওষুধ ব্যবহার করে তা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ ও উপকরণের অভাবে গাজার হাসপাতালগুলো নারীদের অস্ত্রপচার করতে পারছে না। ফলে নারীদের অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে।
৫৭ বছর বয়সী সাআদা আহমেদ একজন বিধবা নারী এবং নয় সন্তানের জননী। তিনি এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত। দ্বিতীয় দফায় গণহত্যা শুরু হওয়ার পর তাঁর অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হয়। ব্যথার তীব্র যন্ত্রণার কারণে তিনি বলেন, এভাবে তিনি মনে হয় আর খুব বেশি দিন বাঁচবেন না। এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণে তাঁর যোনিপথে রক্তপাতও হয়। একজন চিকিত্সক তাঁকে বলেছেন, এই রোগের উপসর্গ হিসেবে তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বুক ধরফর করছে এবং তিনি ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। উচ্চমাত্রার ওষুধ ছাড়া তার রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না।
উত্তর গাজার আল আউদা হাসপাতালে সাআদার অস্ত্রপচার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফা গাজায় হামলা শুরু করার কয়েকদিনের মধ্যে জাবালিয়া ও বেইত লাহিয়ার বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে অক্টোবর ২০২৩ সালের পর ১৩তম বারের মতো তিনি বাস্তুচ্যুত হন। সাআদা বলেন, আমার মনে হয়, আমার কোনো মূল্য নেই। আমি জানি না এই রক্তক্ষরণ থেকে আমার মৃত্যু হবে কি না। আমি জানি আমি কোথায় যাবো। আমি আমার চিকিত্সক ফোন করি, কিন্তু তিনি ফোন ধরেন না। হয়ত তিনিও বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
খালিদা আল সাওয়ার বয়স ৫০ বছর। তিনি সাত সন্তানের মা। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে তাঁর জরায়ুর ফাইব্রয়েড অপসারণের জন্য গাজার আল শিফা হাসপাতালে হিস্টেরেক্টমি হওয়ার কথা ছিল। ৭ অক্টোবরের হামলার কারণে তা সম্ভব হয়নি। কেননা গাজার সব হাসপাতালে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। খালিদা তার অপারেশনের জন্য মরিয়া ছিলেন। তাই তিনি উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় যেতে অস্বীকার করেন। তিনি বার বার আল শিফা হাসপাতালের নারী ও প্রসূতি বিভাগে যান। যেন কোনোভাবে তাঁর অস্ত্রপচারটি হয়। কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে বলা হয়, আমরা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি। এখন প্রসবের মতো অতি জরুরি সেবা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার সুযোগ নেই। তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয় গাজার বাইরের কোনো বেসরকারি হাসপাতালে যেতে। কেননা এখানে খালিদার চিকিত্সা সেবা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই ধ্বংসস্তুপ পেরিয়ে খালিদা কোথায় যাবে? গত বছর এপ্রিল মাসে ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমণে আল শিফা কমপ্লেক্স পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে খালিদার হিস্টেরেক্টমি গ্রহণের শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে যায়।
চিকিত্সক ঘাসান আবু আল কুম্বুজ গাজার একজন সুপরিচিত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি আল শিফা কমপ্লেক্সের মহিলা ও প্রসূতি হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। বর্তমানে তিনি মিসরে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, চিকিত্সা, চিকিত্সা উপকরণ ও ওষুধের অভাব এবং অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতালের ওপর নির্ভর করার কারণে গাজার মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্য অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে আছে। মানসিক চাপের ফলে পিসিওএসে আক্রান্ত নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপুষ্টি ও ভিটামিন ডি-এর অভাবে ৫০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের জরায়ু ফাইব্রয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্ত্রীরোগ, জরায়ু এবং ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের আক্রান্ত নারী রোগীদের মৃত্যুর হার ২০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরো বলেন, তুর্কি হাসপাতালটি ছিল একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল। ২০২৩ সালের নভেম্বরে এটি ধ্বংস হওয়ার পর থেকে, স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত টিউমারগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা অপসারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।