মুসলমানের পরিচয় ও উৎসবের স্বাতন্ত্র্য

  • নীলকন্ঠ অনলাইন নীলকন্ঠ অনলাইন
  • আপডেট সময় : ০৩:১৭:১৪ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫
  • ৭১০ বার পড়া হয়েছে
মানুষের জীবনে নিজেকে প্রকাশ করার মতো বিভিন্ন পরিচয় থাকে। যেমন—ভাষার পরিচয়ে আমরা বাঙালী। ভূখণ্ডের পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশি। এছাড়া পেশার ভিত্তিতে আমাদের বহুমুখী পরিচয় রয়েছে। যেমন— শিক্ষক, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, ব্যবস্থাপক, হিসাব রক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার ইত্যাদি।মানুষ সাধারণত পেশা ভিত্তিক পরিচয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। এসব পরিচয় সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী। আমাদের আরেকটি মূল পরিচয় রয়েছে। সেটি হলো— ধর্মের পরিচয়। অর্থ্যাৎ আমরা ‘মুসলমান’। ইসলাম আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দ্বীন। এই পরিচয়টি মানুষের জন্য চিরস্থায়ী। এই পরিচয়ের সাথে অন্যান্য পরিচয় সাংঘর্ষিক হলে সেগুলো ছেড়ে দিতে হবে অথবা সংশোধন করতে হবে।

যেমন— ‘মুসলমান’ ও ‘মাদকব্যবসায়ী’ পরিচয় একত্রে হওয়া সাংঘর্ষিক। কারণ, ইসলামে ব্যবসা হালাল হলেও মাদকের ব্যবসা হারাম ও নিষিদ্ধ। মাদকব্যবসার মাধ্যমে ‘মুসলমান’ পরিচয় মিথ্যায় রূপান্তরিত হয়। ভাষার পরিচয়ে আমরা বাঙালী। ভাষা আল্লাহর দান। সব ভাষাই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। ভাষার ভিত্তিতে কেউ শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট হতে পারে না। কাজেই আমাদের বাংলাভাষী হওয়া বা বাঙালি হওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে কিংবা যেকোনো উত্সব পালনে এমন কোনো কাজ কাম্য হতে পারে না, যা মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অথবা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। মুসলমান পরিচয় কলুষিত হওয়ার কয়েক বিষয় নিম্নরূপ—

প্রাণির চিত্র বা প্রতিকৃতি ধারণ করা : কোনো প্রাণির চিত্রাঙ্কন ইসলামে অনুমোদিত নয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে তাদের, যারা প্রাণির চিত্র অঙ্কনকারী।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬০৬)

আবার চিত্রাঙ্কনের মতো ইট, পাথর, মাটি বা অন্য কিছুর মাধ্যমে প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণও ইসলামে বৈধ নয়। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, এই প্রতিকৃতি নির্মাতাদের কিয়ামতের দিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাদের সম্বোধন করে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণসঞ্চার করো।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৫১)তবে সৌন্দর্যবর্ধন, স্মৃতিচারণ বা জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে স্তম্ভ, ফলক, মিনার বা অন্য কিছুর প্রতিকৃতি ইসলামী শিল্পকলায় প্রাণীর ভাষ্কর্য নির্মাণের বিকল্প হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ, ফুল-পাতা, নদ-নদী, প্রাকৃতিক দৃশ্য, জড়পদার্থ এবং মসজিদ ইত্যাদির চিত্রাঙ্কন ইসলামী শিল্পকলায় ব্যবহূত হয়ে থাকে। পোশাক, পর্দা, মাদুর, কার্পেট ইত্যাদিতে এধরনের চিত্রের ব্যবহার হতে পারে।

বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ : প্রত্যেকে যার যার বিশ্বাস অনুযায়ী উত্সব পালন করবে—এটাই স্বাভাবিক। যেকোনো উত্সব পালন ও আচার-অনুষ্ঠানে বিজাতীয় সংস্কৃতি মুসলমানদের জন্য পরিত্যাজ্য বিষয়। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে সে তাদের দলভূক্ত বিবেচিত হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩৩)

অশ্লীলতা পরিত্যাজ্য : বর্ষবরণ উদ্যাপন করতে নানাবিধ অশ্লীলতা, নগ্নতা, মদপান, তরুণ-তরুণীর যৌন-উম্মাদনাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা্লের সংবাদ পাওয়া যায়। যেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। ইসলামে কোনো ধরনের অনৈতিক ও অনর্থক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসত্কর্ম ও সীমালংঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯০)

আল্লাহর ছাড়া অন্যের কাছে কল্যাণ কামনা : মুসলমানরা বিশ্বাস করে—কল্যাণ-অকল্যাণ বা মঙ্গল-অমঙ্গলের মালিক মহান আল্লাহ। তাই মহান আল্লাহর কাছে নতুন বছরসহ যেকোনো উত্সবে ইহকালীন ও পরকালীন সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ কামনা করবে। আল্লাহই বান্দার সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ প্রদানকারী। অন্য কেউ নয়। কোরআনে এসেছে, ‘আমি কি তাঁর (আল্লাহর) পরিবর্তে অন্যান্যদের উপাস্যরূপে গ্রহণ করবো? করূণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনই কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। এরূপ করলে আমি প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবো।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত : ২৩-২৪)পরিশেষে বলা যায়, জীবনের সবক্ষেত্রে মুসলমান পরিচয় ধারণ করাই ঈমানের মূল দাবি। এ পরিচয় কলুষিত হয় মতো সকল কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। মুসলমান পরিচয়ের সাথে অন্য পরিচয় সাংঘর্ষিক হলে সেটি বাদ দিতে হবে অথবা সংশোধন করতে হবে। আল্লাহ সে তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

মুসলমানের পরিচয় ও উৎসবের স্বাতন্ত্র্য

আপডেট সময় : ০৩:১৭:১৪ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫
মানুষের জীবনে নিজেকে প্রকাশ করার মতো বিভিন্ন পরিচয় থাকে। যেমন—ভাষার পরিচয়ে আমরা বাঙালী। ভূখণ্ডের পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশি। এছাড়া পেশার ভিত্তিতে আমাদের বহুমুখী পরিচয় রয়েছে। যেমন— শিক্ষক, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, ব্যবস্থাপক, হিসাব রক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার ইত্যাদি।মানুষ সাধারণত পেশা ভিত্তিক পরিচয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। এসব পরিচয় সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী। আমাদের আরেকটি মূল পরিচয় রয়েছে। সেটি হলো— ধর্মের পরিচয়। অর্থ্যাৎ আমরা ‘মুসলমান’। ইসলাম আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দ্বীন। এই পরিচয়টি মানুষের জন্য চিরস্থায়ী। এই পরিচয়ের সাথে অন্যান্য পরিচয় সাংঘর্ষিক হলে সেগুলো ছেড়ে দিতে হবে অথবা সংশোধন করতে হবে।

যেমন— ‘মুসলমান’ ও ‘মাদকব্যবসায়ী’ পরিচয় একত্রে হওয়া সাংঘর্ষিক। কারণ, ইসলামে ব্যবসা হালাল হলেও মাদকের ব্যবসা হারাম ও নিষিদ্ধ। মাদকব্যবসার মাধ্যমে ‘মুসলমান’ পরিচয় মিথ্যায় রূপান্তরিত হয়। ভাষার পরিচয়ে আমরা বাঙালী। ভাষা আল্লাহর দান। সব ভাষাই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। ভাষার ভিত্তিতে কেউ শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট হতে পারে না। কাজেই আমাদের বাংলাভাষী হওয়া বা বাঙালি হওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে কিংবা যেকোনো উত্সব পালনে এমন কোনো কাজ কাম্য হতে পারে না, যা মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অথবা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। মুসলমান পরিচয় কলুষিত হওয়ার কয়েক বিষয় নিম্নরূপ—

প্রাণির চিত্র বা প্রতিকৃতি ধারণ করা : কোনো প্রাণির চিত্রাঙ্কন ইসলামে অনুমোদিত নয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে তাদের, যারা প্রাণির চিত্র অঙ্কনকারী।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬০৬)

আবার চিত্রাঙ্কনের মতো ইট, পাথর, মাটি বা অন্য কিছুর মাধ্যমে প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণও ইসলামে বৈধ নয়। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, এই প্রতিকৃতি নির্মাতাদের কিয়ামতের দিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাদের সম্বোধন করে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণসঞ্চার করো।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৫১)তবে সৌন্দর্যবর্ধন, স্মৃতিচারণ বা জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে স্তম্ভ, ফলক, মিনার বা অন্য কিছুর প্রতিকৃতি ইসলামী শিল্পকলায় প্রাণীর ভাষ্কর্য নির্মাণের বিকল্প হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ, ফুল-পাতা, নদ-নদী, প্রাকৃতিক দৃশ্য, জড়পদার্থ এবং মসজিদ ইত্যাদির চিত্রাঙ্কন ইসলামী শিল্পকলায় ব্যবহূত হয়ে থাকে। পোশাক, পর্দা, মাদুর, কার্পেট ইত্যাদিতে এধরনের চিত্রের ব্যবহার হতে পারে।

বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ : প্রত্যেকে যার যার বিশ্বাস অনুযায়ী উত্সব পালন করবে—এটাই স্বাভাবিক। যেকোনো উত্সব পালন ও আচার-অনুষ্ঠানে বিজাতীয় সংস্কৃতি মুসলমানদের জন্য পরিত্যাজ্য বিষয়। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে সে তাদের দলভূক্ত বিবেচিত হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩৩)

অশ্লীলতা পরিত্যাজ্য : বর্ষবরণ উদ্যাপন করতে নানাবিধ অশ্লীলতা, নগ্নতা, মদপান, তরুণ-তরুণীর যৌন-উম্মাদনাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা্লের সংবাদ পাওয়া যায়। যেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। ইসলামে কোনো ধরনের অনৈতিক ও অনর্থক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসত্কর্ম ও সীমালংঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯০)

আল্লাহর ছাড়া অন্যের কাছে কল্যাণ কামনা : মুসলমানরা বিশ্বাস করে—কল্যাণ-অকল্যাণ বা মঙ্গল-অমঙ্গলের মালিক মহান আল্লাহ। তাই মহান আল্লাহর কাছে নতুন বছরসহ যেকোনো উত্সবে ইহকালীন ও পরকালীন সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ কামনা করবে। আল্লাহই বান্দার সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ প্রদানকারী। অন্য কেউ নয়। কোরআনে এসেছে, ‘আমি কি তাঁর (আল্লাহর) পরিবর্তে অন্যান্যদের উপাস্যরূপে গ্রহণ করবো? করূণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনই কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। এরূপ করলে আমি প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবো।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত : ২৩-২৪)পরিশেষে বলা যায়, জীবনের সবক্ষেত্রে মুসলমান পরিচয় ধারণ করাই ঈমানের মূল দাবি। এ পরিচয় কলুষিত হয় মতো সকল কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। মুসলমান পরিচয়ের সাথে অন্য পরিচয় সাংঘর্ষিক হলে সেটি বাদ দিতে হবে অথবা সংশোধন করতে হবে। আল্লাহ সে তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।