৬৫৬ হিজরি মোতাবেক ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে আরতুগ্রুলের ছেলে উসমানের জন্ম হয়। তাঁর দিকেই উসমানি সাম্রাজ্যের সম্বোধন করা হয়। তিনি যে বছর জন্মগ্রহণ করেন, সে বছরই মঙ্গোলীয়রা হালাকু খাঁর নেতৃত্বে আব্বাসি খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে আক্রমণ করে। এটি ছিল মর্মান্তিক একটি দুর্যোগ। এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন-
তারা শহরে আক্রমণ করে সেখানকার সকল পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা, বৃদ্ধ, যুবক যাদেরই নাগালে পেয়েছে হত্যা করেছে। অনেক মানুষ কূপ, বন্য জন্তুদের আবাস এবং ময়লার ভাগাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। এভাবে তারা অনেকদিন আত্মগোপন করে থাকে। এক মুহূর্তের জন্যও বাইরে বের হতো না। একদল লোক সেখানকার সরাইখানাগুলোতে দরজা বন্ধ করে আত্মগোপন করে; কিন্তু তাতারিরা সেগুলো ভেঙে আগুন লাগিয়ে তাদের বের করে নিয়ে আসে। এরপর লোকেরা দূর দূরান্তে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত তারা মঙ্গোলীয়দের হাতে ধরা পড়ে। মঙ্গোলীয়রা তাদের খোলা ময়দানে পেয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। রক্তে শহরের অলিগলির নালাসমূহ ভরে ওঠে। মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একই অবস্থা দেখা গিয়েছিল। ইহুদি, খ্রিস্টান আর তাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনাকারী কতিপয় মুসলিম ছাড়া আর কেউই রেহাই পায়নি। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ১৯২-১৯৩)
উম্মাহর সেই কঠিন, দুর্যোগময় ও দুর্বলতার সময়টাতে উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমানের জন্ম হয়।
প্রথম উসমানের নেতৃত্বসুলভ গুণ
প্রথম উসমানের জীবন নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের সামনে তার ব্যক্তিত্বের কয়েকটি গুণ ভেসে ওঠে। যেমন তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সেনাপতি, বিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার সবচেয়ে গুরুত্ববহ এবং উল্লেখযোগ্য গুণাবলি হচ্ছে’
বীরত্ব : ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের বুরুসা, মাদানুস, আদ্রানুস, কাত্তাহ, কাস্তালাহ প্রভৃতি অঞ্চলের খ্রিস্টান রাজারা উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান বিন আরতুগ্রুলের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ডাক দেয়। খ্রিস্টানরা এতে ব্যাপকভাবে সাড়া দেয় এবং এই উঠতি সালতানাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ গ্রহণ করে। উসমান তার সৈন্যদল নিয়ে এগিয়ে যান। যুদ্ধের ময়দানে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে তিনি ক্রুসেড-যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন করে দেন। তার বীরত্ব উসমানীদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে যায়। (জাওয়ানিবুল মুক্তিনগ্রাহ ফি তারিখিল উসমানিধিনাল আতরাক, পৃষ্ঠা ১৯৭)
হিকমত বা প্রজ্ঞা : স্বীয় গোত্রের নেতৃত্ব হাতে নেওয়ার পর তিনি ভেবে দেখলেন, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সুলতান আলাউদ্দিনের সাথে মিলিত হয়ে সুসম্পর্ক বজায় রেখে অবস্থান করা বুদ্ধির কাজ হবে। তাই তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং দুর্গ-জয়ে সুলতানকে সাহায্য করেন। এর ফলে তিনি রোমের সেলজুক সুলতান
আলাউদ্দিনের দরবারে আমির হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন। (কিয়ামুদ দাওলাতিল উসমানিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২৫)
ঈমানি জজবা : বুরুসার অধিপতি ইকরিনুসের সাথে যুদ্ধের সময় তার এই গুণের কথা জানা যায়। যুদ্ধ-শেষে ইকরিনুস ইসলাম গ্রহণ করে। সুলতান উসমান তাকে Èবেক’ উপাধি প্রদান করেন। এরপর সে উসমানি সালতানাতের প্রথম সারির সেনাপতিদের কাতারে পৌঁছে যায়। অনেক কনস্টান্টিনোপলিয়ান সেনাপতি উসমানের ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত ছিলেন। তারা উসমানের দেখিয়ে যাওয়া পথ অনুকরণ করে উসমানি সালতানাতকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তখন অনেক মুসলিম সৈন্যদল উসমানি সালতানাতের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে ছিল গাজিয়ারোম অর্থাৎ রোমের একদল যোদ্ধা। তারা আব্বাসীয় খিলাফতের সময় থেকে রোম সীমান্তে একতাবদ্ধভাবে অবস্থান করত এবং মুসলিমদের ওপর রোমীয়দের আক্রমণ প্রতিহত করত।
আরেকদল ছিল ইখওয়ান, অর্থাৎ ভাইদের দল। তারা মুসলিমদের সাহায্য করত এবং যোদ্ধাদের সেবা করার জন্য সৈন্যদলের সাথে অবস্থান করত।
আরেকদল ছিল হাজিয়াতে রোম, অর্থাৎ রোমের হাজিদের কাফেলা। ইসলামী ফিকহ নিয়ে কাজ করত আরেকটি দল। তারা শরিয়তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন। (আত তারাজুযুল হাজারি ফিল আলামিল ইসলামি, ড. আলি আবদুল হালিম, পৃষ্ঠা ৩৩১-৩৩২)
ন্যায়পরায়ণতা : তুর্কি ইতিহাস গ্রন্থ হতে জানা যায়, ৬৮৩ হিজরি মোতাবেক ১২৮৫ হিজরিতে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের কাছ থেকে কুরুহজাহ দুর্গ জয় করার পর আরতুগ্রুল তার ছেলে উসমানের হাতে সে অঞ্চলের শাসনভার ন্যস্ত করেছিলেন। তখন উসমান তুর্কি মুসলিমদের বিপরীতে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের শাসন করেছিলেন। এতে অভিভূত হয়ে এক খ্রিস্টান উসমানকে জিজ্ঞেস করেছিল, কীভাবে আপনি আমাদের কল্যাণ সাধন করেন, অথচ আমরা আপনার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী?
উসমান জবাব দিয়েছিলেন, আমি কেন তোমাদের কল্যাণ কামনা করব না! আমরা তো আল্লাহর ইবাদত করি। তিনি আমাদের বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতকে তার হকদারের কাছে পৌঁছে দাও এবং ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৮)
তার এই ন্যায়পরায়ণতার কারণে লোকটি তার গোত্রসহ ইসলাম গ্রহণ করে। (জাওয়ানির মুক্তিয্যাজ, পৃষ্ঠা ৩৩)