নিউজ ডেস্ক:
বিয়ে ইসলামি সভ্যতার একটি বিশেষ অংশ এ প্রথা হজরত আদম আ: থেকেই চলে আসছে। জাহেলি যুগেও বিয়েপ্রথা চালু ছিল ও বিয়ে সম্পর্কে উন্নত ধারণা পোষণ করা হতো। যদিও রীতি-নীতির মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। যেমন- বিবাহের জন্য কনের মতামতের কোনো প্রয়োজন হতো না, তার অভিভাবক খেয়াল-খুশি মতো যেখানে ইচ্ছা বিয়ে দিতো। তা ছাড়া তালাকের ব্যাপারেও স্বামীর মতামতই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতো। সেখানে স্ত্রীদের কোনো ভূমিকা ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা স্ত্রীরও মালিক হয়ে নানাবিধ অন্যায় অত্যাচার করতো এবং তাদের স্বাধীনতা ক্ষুণœ করতো। এক কথায় সেকালে মহিলারা পুরুষদের শুধু ভোগের পণ্যই নয় ; বরং তারা গৃহপালিত পশুর মতো ব্যবহৃত হতো। সমাজে তাদের মূল্যায়ন হতো না, বরং কন্যাসন্তান কুলক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতো।
ইসলামের আগমন : * হজরত রাসূলুল্লাহ্ সা:-এর নবুয়ত প্রাপ্তির সাথে সাথেই সমাজে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হলো। সমাজে মেয়েদের এ শোচনীয় অবস্থার নিরসন ঘটল। জাহেলি যুগের ইচ্ছেমতো বিয়ে ও তালাক প্রদানের নীতি সম্পূর্ণ বদলে গেল। মেয়েদের ইজ্জত বৃদ্ধি পেল। এতদিন যে মেয়েরা নির্যাতিত হতো, ইসলাম সেখানে ঘোষণা করল : মেয়েরাও তোমাদেরই মতো মানুষ, আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও মায়া-মমতা সৃষ্টিকারী।
আল্লাহ বলেন, আল্লাহর নির্দেশনাবলির মধ্যে একটি হলো- তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা স্ত্রীদের কাছে শান্তিতে অবস্থান করতে পার এবং তিনি তোমাদের (দাম্পত্য জীবনের) মধ্যে ভালোবাসা ও মমতা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা-রুম : ২১)
বিয়ের উদ্দেশ্য : বিয়ে শুধু ভোগ-বিলাস ও যৌন তৃপ্তি অন্বেষণই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়; বরং এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে- নিজকে পাপাচার ও ব্যভিচার থেকে মুক্ত রাখা ও সন্তান জন্ম করা। এ ব্যাপারে আমরা রাসূল সা:-এর যুগের একটি ঘটনা স্মরণ করতে পারি।
মু’কাল ইবনে ইয়াসার বর্ণনা করেন : জনৈক ব্যক্তি রাসূল সা:-এর দরবারে এসে আরজ করল- আমি রূপসী, বংশ মর্যাদাশীল এক মহিলাকে ভালোবেসেছি, অথচ সে বন্ধ্যা। আমি কি তাকে বিয়ে করব? হুজুর সা: বললেন- না। অতঃপর দ্বিতীয়বার এলে তখনো নিষেধ করলেন। তৃতীয়বার এলে তখন বললেন- ‘তোমরা সন্তান জন্মদায়িনী, প্রেম-প্রীতির অধিকারিণী রমণীদের বিয়ে করো। কারণ আমি (কেয়ামতের দিন) অন্যান্য উম্মতের ওপর তোমাদের সংখ্যাধিক্যের গৌরব করব।’
এ হাদিসে এ কথাই প্রমাণিত যে, বিয়ের উদ্দেশ্য সন্তান জন্ম দেয়া। আর শুধু ভোগ-বিলাসের জন্য বা নির্ধারিত সময়ের জন্য বিয়ে ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে বৈধ থাকলেও তা পরবর্তী যুগে চিরতরে হারাম করা হয়েছে।
বিয়ের নিয়মকানুন : বিয়ে সম্পাদনায় কতগুলো শর্ত আছে, যেগুলো পূরণ না করলে বিয়ে শুদ্ধ হবে না। সে শর্তগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো-
১. বিয়ে কনের অভিভাবকের অনুমতি (নাবালেগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)। অভিভাবক না থাকলে শাসনকর্তার অনুমতিতে বিয়ে সম্পাদন করতে হবে।
২. দু’জন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষীর সম্মুখে বিয়ে সম্পাদন হতে হবে; সাক্ষী ছাড়া বিয়ে শুদ্ধ হবে না। তবে ইমাম মালিক রহ:-এর মাজহাবে বিয়ের অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে বিয়ে প্রদর্শনী। তাই সাক্ষীর উপস্থিতি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমেও এটা প্রদর্শনী হতে পারে, তাতেও বিয়ে শুদ্ধ হবে।
৩. প্রথমে খুতবা ও পরে ইজাব ও কবুল হওয়া উচিত। ইজাব ও কবুলের সাথে হামদ ও নাত থাকা উচিত, যেমন- মেয়েপক্ষ থেকে নির্ধারিত ব্যক্তি বলবে, আলহামদুলিল্লাহ আমার… কে… এর সাথে বিয়ে দিয়ে দিলাম। ছেলে বলবে, আলহামদুলিল্লাহ আমি কবুল করলাম।
বিয়ের হুকুম : বিয়ে করা স্বাভাবিকভাবে সুন্নত হলেও কোনো কোনো সময় তা ফরজ, ওয়াজিব, হারাম, মাকরুহ ও মুবাহও হয়। এখানে শুধু ফরজ ও হারামের বিষয়টি তুলে ধরব।
বিয়ে ফরজ : যখন কারো বিয়ে না করলে হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয় এবং সে বিয়ের যাবতীয় দায়দায়িত্ব পালনেও সক্ষম; যেমন স্ত্রীর ভরণপোষণ ও আনুষঙ্গিক খরচাদি এবং স্ত্রী তার দ্বারা কোনো প্রকার অত্যাচারিত হবে না- এর নিশ্চয়তা প্রদান করতে সক্ষম, তখন এরূপ ব্যক্তির ওপর বিয়ে ফরজ।
হারাম বিয়ে : যখন কোনো পুরুষ নিশ্চিত হবে যে, সে বিয়ে করলে তার স্ত্রী নির্যাতিত হবে, তখন তার জন্য বিয়ে করা হারাম। যেমন- যদি স্বামী-স্ত্রীর যাবতীয় চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়, অর্থাৎ তার শারীরিক দুর্বলতা বা অর্থনৈতিক দুর্বলতা ইত্যাদি থাকে।
কী ধরনের কনেকে বিয়ে করা উচিত : বিয়ে এমন একটি বন্ধন যা স্বাভাবিকভাবে চিরদিন স্বামী-স্ত্রী একত্রে থাকার জন্যই হয়ে থাকে। তাদের আশা, তারা সুখের নীড় গড়ে তুলবেÑ এ জন্য বিয়ের আগেই একে অপরকে ভালোভাবে দেখে-শুনে নেয়া প্রয়োজন। কারণ ভালোভাবে দেখে-শুনে বিয়ে না করলে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ জন্যই ইসলাম তথা রাসূল সা: বিয়ের আগে কনেকে ভালোভাবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ বিয়ে এমন ছেলেখেলা নয় যে, ভালো লাগল না বলে বাজারে বিক্রির মতো নতুন একটি নিয়ে আসব। তাই বৈবাহিক জীবন সুখময় করতে হলে বিয়ের আগেই কুফু তথা বিভিন্ন দিকে লক্ষ্য রাখা অতীব জরুরি। নতুবা পরে ভালোবাসা তো থাকেই না’ বরং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রথমে দা-কুমড়া সম্পর্ক, পরে চিরদিনের জন্য বিয়ে-বিচ্ছেদের মতো অশুভ কাজও হয়ে যায়। তাই দেখা যাক পাত্রী চয়নে রাসূল সা: কী বলেছেন?
একজন মহিলাকে বিয়ে করার সময় চারটি লক্ষ্য করা হয় :
১. তার ধন-সম্পত্তি, ২. বংশ মর্যাদা, ৩. রূপ-সৌন্দর্য ও ৪. তার দ্বীনদারি। তবে তোমরা দ্বীনদার মেয়েদেরকে বিয়ে করে সুখ-শান্তিতে থাক। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
বিয়ের মোহর : বিয়ের মোহর দেয়া অপরিহার্য। তবে মোহর স্বামীর আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করেই নির্ধারণ করা উচিত, যা তার জন্য আদায় করা সম্ভব। অনেক মোহর নির্ধারণ করে শুধু লোককে জানিয়ে পরবর্তীতে তা আদায় না করলে মহাপাপী হবে।
মোহরের পরিমাণ : শরিয়ত মোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করেনি; তবে আবু হানিফা রহ:-এর মতে, এর সর্বনিম্ন পরিমাণ হবে ১০ দিরহাম (বা পৌনে তিন তোলা রৌপ্য) বা তার মূল্য। এ ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
যাদেরকে বিয়ে করা হারাম : যাদের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম, আল্লাহ তাদের কথা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে- ১. পিতার স্ত্রী, তাতে সৎ মা-ও শামিল, ২. নিজ মা, গর্ভধারিণী, অনুরূপ দাদী-নানীও হারাম, ৩. কন্যা, পুত্রের কন্যা, কন্যার কন্যা এবং তাদের ধারাবাহিকতা নিম্নদিকে যতই বিস্তার লাভ করুক না কেন, ৪. বোন, সৎ বোন, দুধ বোনও এর মধ্যে শামিল, ৫. ফুফু, পিতার আপন বোন হোক না সৎ বোন, ৬. খালা, ৭. ভাইয়ের কন্যা, ৮. বোনের কন্যা, ৯. দুধ মা-শৈশবে যার দুধ পান করেছেন, ১০. দুধ বোন, ১১. স্ত্রীর মা, ১২. স্ত্রীর কন্যা, ১৩. ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী। উল্লেখ্য, পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা হারাম নয়, ১৪. দুই বোনকে একত্রে বিয়ে করা। তদ্রুপ, কোনো মেয়েকে এবং তার ফুফু অথবা খালাকেও একত্রে বিয়ে করা হারাম। ১৫. অপরের স্ত্রী, যতক্ষণ না সে তাকে তালাক দেবে (অথবা বিধবা না হবে)। (নিসা:২৩-২৪)
আরো কিছু নারীকে বিয়ে করা হারাম করা হয়েছে। তন্মধ্যে রয়েছে- মুশরিক ও কাফির নারী। এদেরকে মুসলমান না করে বিয়ে করা বৈধ নয়। এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো। এ ব্যাপারে বিশদভাবে জানার জন্য ফিকাহ এর কিতাবগুলো দেখা যেতে পারে।
বহু বিয়ে : জাহিলী যুগে বিয়ের সংখ্যার কোনো নীতি নির্ধারিত ছিল না। যে যতটি ইচ্ছা বিয়ে করত। ইসলাম এসে একে চারটির মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। তবে একাধিক বিয়ে প্রয়োজনে বৈধ হলেও স্বাভাবিকভাবে বহু বিয়ে সংসারে কলহের একটি প্রধান উৎস। রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবায়ে কিরাম রা: একাধিক বিয়ে করেছেন। তাদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। কিন্তু আমাদের দেশে বহু বিয়ের কারণে সমাজে প্রায়ই বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে। ইসলাম বহু বিয়ে স্বাভাবিকভাবে সবার জন্য বৈধ রাখেনি; বরং শর্তসাপেক্ষে বৈধ রেখেছে। আর সে শর্ত হলো- স্ত্রীদের মধ্যে আদল-ইনসাফ। এ শর্ত কার্যকর করতে না
পারলে তার জন্য একটি বিয়ের হুকুম। আল্লাহ বলেন-
‘তোমরা যদি স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করতে না পারার আশঙ্কা করো, সে ক্ষেত্রে একজনকেই বিয়ে করো।’
ব্যাপারটি বড়ই কঠিন। তাই এ ব্যাপারে সামনে অগ্রসর হতে চিন্তাভাবনা করতে হবে। সুবিচার কায়েম করতে না পারলে কেয়ামতের দিন ভীষণ আজাব ভোগ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের ইসলামের তরিকা মতো চলার তৌফিক দিন।