বাহাঈ একটি আঞ্চলিক ধর্ম। এর উদ্ভব ঘটে ইরানে। এ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মির্জা হোসেন আলি ইবন আব্বাস। পরবর্তীকালে তিনি বাহাউল্লাহ বা আল্লাহর জ্যোতি উপাধি ধারণ করেন এবং এ উপাধিতে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। তাঁর এই নামের দিকে সস্পর্কযুক্ত করে এ ধর্মের অনুসারীদের বাহাঈ বলা হয়ে থাকে। (নাসির আবদুল্লাহ আল-কিফারি, আল-আদইয়ান ওয়াল মাজাহিব, পৃ.১৫৬)
মির্জা হোসেন আলি ১২২৩ হিজরি মোতাবেক ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের মুহাররম মাসে ইরানের তেহরান নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাঁর জন্মস্থান সমপর্কে লিখেছেন, তিনি ইরানের মাজেন্দারান জেলার নূর নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এ জন্য তাকে মাজেন্দারানী ও নুরি বলা হয়। (আদিল আব্দুল মুনইম আবুল আব্বাস, আল-বাহাইয়্যাহ হাকায়িক ওয়া ওছায়িক (কায়রো : মাকতাবাতুল কোরআন, ২০০৬ খ্রি.) পৃ. ২১)
১৮৬৩ সালের ২১ এপ্রিল তার পূর্বসুরি মির্জা আলী মুহাম্মাদ বাবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাহাউল্লাহ নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করেন। (জাতীয় বাহাই পরিষদ, বাহাউল্লাহ (ঢাকা : জাতীয় বাহাই কেন্দ্র ১৯৯৩) পৃ. ৬-৭)
বাহাউল্লাহ তেহরানের কারাগারে চার মাস কাটিয়েছেন। এরপর ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তাকে বাগদাদে স্থানান্তরিত করা হয়। ১১ বছর পর তাকে কিছুদিন ইস্তাম্বুলে এবং পরে প্রায় পাঁচ বছর আক্কা নগরে নির্বাসন দেওয়া হয়। এ সময় তিনি ‘কিতাবুল আকদাস’ রচনা করেন।
ধর্ম-বিশ্বাস
অন্যান্য ধর্মের মতই বাহাঈ ধর্মের কিছু ধর্ম-বিশ্বাস আছে। যেগুলোর ওপর এ ধর্মের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। নিচে তাদের ধর্ম-বিশ্বাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপিত হলো—
ঈশ্বরতত্ত্ব : বাহাঈরা বাহাউল্লাহকে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি বা প্রতিবিম্ব বলে মনে করে। তারা বিশ্বাস করে যে যুগে যুগে ঈশ্বর তার প্রিয় মানুষের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। যেমন ঈসা (আ.)-এর মধ্য দিয়েধর্ম ঈশ্বরের মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে তেমনি বাহাউল্লাহর মধ্য দিয়ে ঈশ্বর এই নশ্বর জগতে মানুষের মুক্তির জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। (আল-বাহাঈয়্যাহ, পৃ.৩৩)
বায়তুল্লাহহ জিয়ারত নিষিদ্ধ : বাহাঈ ধর্মে বায়তুল্লাহর জিয়ারতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের মতে, বায়তুল্লাহর পরিবর্তে ইসরাঈলের ‘আকা’ নামক স্থান জিয়ারত করা ফরজ। এখানে কারসেল পর্বতের পাদদেশে বাহাঈ ধর্মের তিন প্রধান ব্যক্তির সমাধি আছে। ইউনিভার্সেল হাউজ অব জাস্টিস তীর্থ মন্দিরের উদ্দেশ্য যাত্রা পুণ্যের কাজ। তাদের ধর্মমতে বছরে ৯ দিন ইসরাঈলের এই তীর্থ ড়্গেত্রে তীর্থ করতে যাওয়া বাহাঈদের জন্য ফরজ। (মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন, ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ (ঢাকা : থানবি লাইব্রেরী, ২০০৪ খ্রি.), পৃ. ২৯৬)
কিয়ামত অস্বীকার : বাহাঈদের ধর্মমতে কিয়ামত বলতে কিছু নেই। তারা পরকাল পুনরুত্থান হিসাব নিকাশকে অস্বীকার করে। তাদের মতে কিয়ামত দুপ্রকার। ১. কিয়ামতে সুগরা, তা হলো আল্লাহর রুহ মনুষ্যদেহে অবতীর্ণ হয়ে তা ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি ধারণ করা। এ সুত্রে আল্লাহর নাফস হলো, বাহাউল্লাহ। ২. কিয়ামতে কুবরা—তা হলো ঈশ্বরাত্মা বাহাউল্লাহর দেহে বিদ্যমান। আর পুনরুত্থান হলো, রুহের জাগতিক চেতনা এবং হিসাব হলো মুমিনদের মধ্যে ফায়সালা করা। কাফির ও বাহাউল্লাহর মধ্যে আল্লাহর শারীরিক আকৃতি রয়েছে। এর মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করাকে হিসাব বলা হয়। আল্লাহর দর্শন বলতে মানবীয় শরীর কাঠামোকে দেখা, যে শরীরে আল্লাহ অবতারিত হয়েছেন। আর আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত্ করার অর্থ হলো, বাহাউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত্ করার নামান্তর। (আল-বাহাইয়্যাহ, পৃ.৩৯)
জান্নাত-জাহান্নাম অস্তিত্বহীন : বাহাঈ ধর্ম-মতে জান্নাত জাহান্নামের কোন অস্তিত্ব নেই। আত্মিক শান্তিই হলো জান্নাত। বাহাঈরা বাহাউল্লাহকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করার কারণে তাদের অন্তরাত্মা প্রশান্তি ও সুখ সমৃদ্ধ। এটিই তাদের জন্য জান্নাত। আর অন্তরাত্মার সুখ ও প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত হওয়াকে জাহান্নাম বলা হয়।
বাহাঈ শরিয়ত
তাহারাত ও ওজু : বাহাঈ শরিয়তে সকল বস্তুই পবিত্র। মানুষের বীর্যও পবিত্র। এগুলো পাঁচবার ‘বিসমিল্লাহে আতহার’ বলে খেলে তা পবিত্র হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে তাদের ধর্ম গ্রন্থ কিতাবুল আকদাসে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ প্রত্যেক বস্তু থেকে তাহারাতের বিধান উঠিয়ে নিয়েছেন। এটি আল্লাহর একটি বিশেষ অনুকমপা। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও সম্মানিত।’ (কিতাবুল আকদাস, শ্লোক নং ৭৪-৭৫)
নামাজ : বাহাঈরা নতুন পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করে। তাদের ধর্মে নামাজের সংখ্যা ৯ রাকাত, যা তিন সময়ে ইসরাইলের ‘আক্কা’ শহরমুখী হয়ে আদায় করতে হয়। (মূলভাষ্য : আরবি আছে দ্র. কিতাবুল
তারা তিন সময় তথা সকাল, দুপুর ও বিকেলে এ নামাজগুলো আদায় করে থাকে। তারা এ নামাজগুলোর নাম দিয়েছে যথাক্রমে আস সালাতুল কুবরা, আস সালাতুল উসতা এবং আস সালাতু সুগরা। (আল-বাহাঈয়্যাহ, পৃ. ৪৫)
এ নামাজগুলোতে কোনো রুকু-সিজদা নেই। শুধু দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
কিবলা : ‘আক্কা’ হলো বাহাঈদের কিবলা। আক্কা হলো বর্তমান ইসরাঈলের উত্তরাঞ্চলীয় এক প্রাচীন নগরী। এদিকে মুখ করে বাহাঈরা নামাজ আদায় করে। যেহেতু তাদের কথিত নবী এ আক্কাতে দীর্ঘ দিন নির্বাসিত ছিল, সেহেতু এ স্থানকে তারা কিবলা হিসেবে মেনে থাকে। এ প্রসঙ্গে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে বলা হয়েছে, যখন তোমরা নামাজ পড়ার ইচ্ছে করবে তখন তোমরা তোমাদের মুখকে আক্কা-এর দিকে ঘুরাবে। এটিকে আল্লাহ তাআলা ঊর্ধ্বজগদ্বাসীদের জন্য তাওয়াফের স্থান, মাদায়িনবাসীদের জন্য কিবলা এবং আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তার উত্সস্থল নির্ধারণ করেছেন।
রোজা পালন : বাহাঈ ধর্মে বছরে মাত্র ১৯ দিন রোজা পালন করলেই চলে। বাহাঈরা ১৯ দিনে মাস গণনা করে। সুবহে সাদিক থেকে তাদের রোজা শুরু হয় না। রোজার সময় শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকলেই চলে। মার্চ মাস রোজার জন্য আরামদায়ক। তাই তারা রমজান মাস বাদ দিয়ে মার্চ মাসে ১৯ দিন রোজা পালন করে। ২১ মার্চ রোজার শেষদিন। (আল-বাহাঈয়্যাহ, পৃ. ৪৬)
হজ : এ ধর্মে হজব্রত পালন করা নিষিদ্ধ। তার শরিয়ত অনুযায়ী তার সমাধিস্থল আক্কায় হজ করাকে ওয়াজিব করা হয়েছে। তবে মেয়েদের হজ করার প্রয়োজন নেই। বর্তমান ইসরাঈল সরকার বিনাশর্তে প্রত্যেক বাহাঈকে আক্কাতে হজ করার সুযোগ দিয়ে থাকে। (আল-বাহাঈয়্যাহ, পৃ. ৪৭)
জাকাত : বাহাঈ ধর্মে জাকাত বিষয়ে সুসপষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। তাদের ধর্ম গ্রন্থে এতটুকু বলা হয়েছে, জাকাত বিষয়ে আল-কোরআনে বর্ণিত অনুসৃত নীতির আমল করতে হবে।
বৈবাহিক বিধান : বাহাঈ শরিয়ত প্রবর্তক বাহউল্লাহর মতে, কোনভাবে দুই এর অধিক বিবাহ করা যাবে না অথচ বাহাউল্লাহ তিনটি বিয়ে করেছিলেন।
গান-বাজনা : এ ধর্মে আনন্দ উপভোগের জন্য সুললিত কণ্ঠে গান বাজনা বৈধ। (কিতাবুল আকদাস, পৃ. ৩২, শ্লোক-৫১)
ব্যভিচারের শাস্তি : এ ধর্মে ব্যভিচারের লঘু শাস্তির বিধান রয়েছে। কেউ যদি ব্যভিচার করে তাহলে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে ৯ মিসকাল স্বর্ণ জরিমানা হিসেবে বায়তুল আদলে (বাহাঈ কোষাগার) জমা দিতে হবে। তারা যদি পুনরায় ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তাহলে আগের ডবল জরিমানা তথা আঠারো মিছকাল স্বর্ণ বায়তুল আদলে জমা দিতে হবে। (কিতাবুল আকদাস, পৃ. ৩১, শ্লোক-৪৯)
ধর্মীয় উত্সব : বাহাঈদের দৃষ্টিতে ১৯ মাসে এক বছর হয়। প্রত্যেক মাস হয় ১৯ দিনে। বাহাঈ বছর অনুযায়ী ঈদে নওরোজ শুরু হয় ২১ মার্চ।
বাহাঈদের পাঁচটি বড় উত্সব আছে। সেগুলো হলো, নিম্নোরূপ—
১. ঈদে নওরোজ : এটি প্রত্যেক বছরে ২১ মার্চে অনুষ্ঠিত হয়।
২. ঈদে রিদওয়ান : এটি ১২ দিনব্যাপী উদযাপিত হয়ে থাকে যা ২১ এপ্রিল থেকে শুরু করে ২ মে
পর্যন্ত চলে। এ উত্সবে বাহাউল্লাহকে প্রভু ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
৩. বাহাউল্লাহর জন্ম উত্সব: ১২ অক্টোবর ১দিন ব্যাপী।
৪. বাবের দাওয়াত ঘোষণা উত্সব : ৫ জমাদিউল উলা। উপরিউক্ত উত্সব ছাড়া বাহাঈ ধর্মে নিচে
বর্ণিত কয়েকদিন কার্যবিরতি অপরিহার্য :
মহরমের ১ ও ২ তারিখ এবং ১, ৯ ও ১২ বাহাঈ মাসে সকল প্রকার কার্য থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। এ তারিখগুলোতে যথাক্রমে বাহাউল্লাহর মৃত্যু, আল-বাবের মৃত্যুদণ্ড এবং বাবের দাওয়াতি কার্যক্রম ঘোষণা করা হয়। (আল-বাহাঈয়্যাহ, পৃ. ৬১)
বাহাঈ ধর্মগ্রন্থ
বাহাঈ ধর্মগ্রন্থের নাম কিতাবুল আকদাস। (হাকিকাতুল বাহাঈয়া ওয়াল বাবিয়া, পৃ. ১১৯)