ইউরোপে চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বেলজিয়ামের রাজনৈতিক দল ফ্লেমিস ইন্টারেস্টের উদ্যোগে ব্রাসেলসের দক্ষিণাঞ্চলে গত ২ সেপ্টেম্বর কিছু বেলজিয়াম নাগরিক ইসলাম ও অভিবাসনবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ করে।
আবার ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইতালির নির্বাচনে জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বাধীন চরম ডানপন্থী ব্রাদার্স অব ইতালি দল বিজয়ী হয়ে মধ্য-ডানপন্থী কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। ব্রাদার্স অব ইতালি একটি চরম ডানপন্থী ও নব্য ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। এদিকে, ইউরোপের অন্যতম সুখী দেশ হিসেবে পরিচিত ফিনল্যান্ডের সংসদেও চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতালি, স্পেন, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডানপন্থী পপুলিস্টদের মিছিল ও কর্মসূচি সাধারণত সংবিধান লঙ্ঘনের দিকে এগোচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাথিজ রুডুইজনের মতে, ইউরোপে চরম ডানপন্থী রাজনীতির জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছরের ৩১টি দেশের জাতীয় নির্বাচনে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ ইউরোপীয় ভোটার মূলধারার রাজনৈতিক দলের বাইরে ভোট দিয়েছেন। একবিংশ শতকের শুরুর দিকে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২০ শতাংশ, আর গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের শুরুতে ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। অর্থাৎ, বর্তমানে প্রতি তিনজনের একজন ইউরোপীয় ভোটার মূলধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে চরম ডানপন্থী বা অন্য বিকল্প শক্তিগুলোর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। ভোটারদের এই পরিবর্তনের একটি বড় অংশই চরম ডানপন্থীদের পক্ষে চলে যাচ্ছে।
এই পরিবর্তন শুধু রাজনৈতিক দলের মানচিত্রেই নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব ফেলছে। চরম ডানপন্থী দলগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, জাতীয়তাবাদী আবেগ এবং মূলধারার রাজনীতির প্রতি জনসাধারণের আস্থা হ্রাসের মতো বিষয়গুলো বড় ভূমিকা রাখছে।
এই লেখায় ইউরোপে চরম ডানপন্থীদের বর্তমান প্রভাব এবং তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটি ইউরোপের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
চরম ডানপন্থী বা অতি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল হলো এমন রাজনৈতিক সংগঠন, যা অতি-জাতীয়তাবাদী, কর্তৃত্ববাদী এবং দৃঢ় মতাদর্শে বিশ্বাসী। এ দলগুলো ভিন্নমত গ্রহণে অসহিষ্ণু এবং প্রায়শই ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ রক্ষায় উচ্চকণ্ঠ। তারা শক্তিশালী সীমানা রক্ষার পক্ষে এবং বহু-সংস্কৃতিবাদ ও বিশ্বায়নের বিরোধিতা করে (Mamon, 2009)।
চরম ডানপন্থী দলগুলোর একটি সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা না থাকলেও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের চিহ্নিত করে। এ ধরনের দলগুলোকে কখনো র্যাডিক্যাল রাইট, জনতাবাদী (পপুলিস্ট), ডানপন্থী পপুলিস্ট, বা জনতাবাদী র্যাডিক্যাল রাইট হিসেবেও অভিহিত করা হয় (Mudde, 2007)।
চরম ডানপন্থীদের মূল বৈশিষ্ট্য:
– ন্যাটিভিজম: এই দলগুলোর বিশ্বাস, একটি রাষ্ট্রের স্বরূপ হবে সমজাতীয়। তারা মনে করে, অভিবাসন এবং ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, বিশেষত ইসলাম, জাতি-রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।
– কর্তৃত্ববাদ: শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ক্ষমতা এবং সীমিত রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে তারা অবস্থান নেয়।
– জাতীয়তাবাদী আদর্শ: জাতীয় ঐক্য ও ঐতিহ্যের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের প্রচার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান ঘটে। ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি (ইতালি), নাৎসি পার্টি (জার্মানি), এবং ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (অস্ট্রিয়া) ছিল এই মতাদর্শের প্রতীক। এই দলগুলো সেই সময় জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ প্রচার করেছিল এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ও সীমিত রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। তাদের কর্মকাণ্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়; এটি আজও ইউরোপ ও বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
ইউরোপের বর্তমান চিত্র:
বর্তমানে ইউরোপে চলমান বন্দোবস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল রয়েছে ২৩৪, যার মধ্যে ১১২টি চরম-ডানপন্থী। ব্রাদার্স অব ইতালির ২০২২ সালের একক ভোট শেয়ার ২৬%, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২২ এর মারি লি পেনের প্রাপ্ত ভোট ৪১.৪৬%, জার্মানিতে অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (AfD) এর ২০২১ সালের নির্বাচনে ভোট শেয়ার ১০.৩%, স্পেনের চরম ডানপন্থী দল ভক্স (VOX) এর ভোট পায় ১৫%, হাঙ্গেরির ভিক্টর অর্বানের চরম-ডানপন্থী দল ২০২২ এর নির্বাচনে ৫৯% ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে, যাদের সবগুলো চরম-ডানপন্থী দল। এর মধ্যে ইতালি, ফিনল্যান্ড (the Finns), হাঙ্গেরিসহ বিভিন্ন দেশ কোয়ালিশন বা এককভাবে চরম-ডানপন্থীদের সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
কেন বাড়ছে এই চরম ডানপন্থী দল?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। দেশগুলো মুক্তি পায় ফ্যাসিবাদ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, এবং বেকারত্বের সংকট থেকে। ধীরে ধীরে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যার ফলে ইউরোপীয়রা চরম ডানপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। এর বিপরীত চিত্র দেখা গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন ইউরোপে বেশ কয়েকটি চরম ডানপন্থী দলের উত্থান ঘটে।
মূলধারার রাজনীতির প্রতি মোহভঙ্গ:
মূলধারার রাজনীতির প্রতি আস্থা হারানো চরমপন্থী ডান বা বাম রাজনৈতিক দলের উত্থানের অন্যতম প্রধান কারণ। ইউরোপের মানুষ গণতন্ত্রকে সরকার পরিচালনার আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিলেও সরকারগুলোর কার্যকারিতায় তারা ক্রমেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছে। অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং এর ফলে সৃষ্ট অভিবাসন নীতির কারণে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করছে। এই পরিস্থিতিতে চরম ডানপন্থী দলগুলো সুযোগ গ্রহণ করছে। তারা জনগণকে আশ্বস্ত করছে যে, ক্ষমতায় এলে তারা বর্তমান সমস্যাগুলোর সমাধান করবে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০৭ সালে ৫১% ফরাসি নাগরিক ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছিল, যেখানে ৩৪% মানুষ আস্থা পোষণ করেনি। কিন্তু ২০১৮ সালে এই চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। ৫৭% নাগরিক EU-র প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করে, এবং মাত্র ৩৩% এর প্রতি আস্থা রাখে। এই পরিবর্তন সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অনাস্থা এবং অসন্তোষেরই প্রতিফলন।
বিশ্বায়ন ও বহু-সংস্কৃতি বিরোধিতা:
বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীজুড়ে মানুষের অবাধ চলাচল উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এক মহাদেশের মানুষ এখন অন্য মহাদেশে চাকরি করতে পারছে কিংবা উন্নত জীবনের আশায় সেখানে স্থায়ী হচ্ছে। এক মহাদেশের মানুষ এখন অন্য মহাদেশে চাকরি করতে পারছে কিংবা উন্নত জীবনের আশায় সেখানে স্থায়ী হচ্ছে। এই বিশ্বায়নের প্রভাবে ইউরোপে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সমাগম বেড়েছে। কেউ চাকরির জন্য, কেউবা উন্নত জীবনের প্রত্যাশায়। এর ফলে ইউরোপে চাকরি সংকট ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে, পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে নতুন শ্রেণীবৈষম্য। বিশ্বায়নের যুগে আধুনিকায়নের ফলে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী তৈরি হয়ে যায়। যার দরুন সৃষ্ট অভিবাসন বেকারত্ব ও আইডেন্টিটি সমস্যা তৈরি করে। এছাড়াও একই শহরে ভিন্ন সংস্কৃতির হার বাড়ে কারণ ভিন্ন দেশের মানুষ জড়ো হয়। এর ফলে চরম ডানপন্থী দল সুযোগ পায়। তারা বিশ্বায়নের বিরোধিতা করে বদ্ধ অর্থনীতির কথা বলে, নিজ সংস্কৃতি রক্ষার কথা বলে ইত্যাদি।
অভিবাসন:
ইউরোপে চরম-ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অভিবাসনবিরোধিতা। তারা বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট, এবং সংস্কৃতির মিশ্রণের জন্য অভিবাসনকে দায়ী করে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার তত্ত্ব অনুযায়ী, নেটিভ ইউরোপিয়ানরা নিজেদের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে অভিবাসীদের অবস্থার তুলনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করে। বর্তমান সরকারের অভিবাসন নীতিকে হাতিয়ার করে এই দলগুলো ভোটারদের আকৃষ্ট করে। জার্মানির এঙ্গেলা মার্কেলের অভিবাসী নীতির বিপক্ষে ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ দল প্রচারণা চালায়, মার্কেলকে ব্যঙ্গ করা হয় রিফিউজি চ্যাঞ্চেলর বলে। ২০১১ সালের একটি সার্ভে অনুযায়ী ৭১% জার্মান অভিবাসনকে সিরিয়াস সমস্যা মনে করে। তেমনি বেলজিয়ামে দেখা যায় অভিবাসন বিরোধী বিক্ষোভ। এভাবে অভিবাসনের ইতিবাচক দিক রেখে নেতিবাচকভাবে প্রচার করে র্যাডিকাল ডানপন্থী দলের উত্থান ঘটে।
ইসলামোফোবিয়া:
শুরুতে উল্লেখিত ঘটনায় বিক্ষোভকারীদের হাতে ইসলামবিদ্বেষী পোস্টার দেখা যায়। ইউরোপীয় নাগরিকদের একটি বড় অংশ মনে করে, মুসলিমরা তাদের দেশের জন্য সমস্যা তৈরি করছে এবং দেশের প্রতি অনুগত নয়। মুসলিম সংস্কৃতি এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির পার্থক্যের কারণে তারা ধারণা করছে মুসলিমরা ইউরোপীয় দেশ ও সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিলুপ্তির কারণ হতে পারে। গত বছরে ইংল্যান্ডে মুসলিমবিরোধী অপরাধের মাত্রা বেড়েছে ৪২ শতাংশ। একই চিত্র দেখা যায় ইউরোপের অন্য দেশেও, ফ্রান্সে ২০২০ সালে বাড়ে ৫৩%, জার্মানিতে ২০১৯ সালে মুসলিমবিরোধী অপরাধ হয় ৮৭১টি। ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে ইউরোপীয় র্যাডিকাল ডানরা সহজেই ভোট ব্যাংক বৃদ্ধি করে।
সমজাতীয় জাতীয়তাবাদ:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদ মূলত সমজাতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণা নিয়ে পরিচালিত হয়েছিল, যার ফলে সংখ্যালঘু ইহুদিরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। তবে আধুনিক রাষ্ট্রগুলো আর জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নয়, বরং নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সমতা একটি আধুনিক নীতি, যা নিশ্চিত করে যে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার প্রতি রাষ্ট্র সমান আচরণ করবে।
কিন্তু যখন কোনো রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদকে তার প্রধান নীতি হিসেবে গ্রহণ করে, তখন সেখানে সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হয়। বর্তমানে ইউরোপে স্বজাতীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাব বাড়ছে, যা চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের উত্থানকে ত্বরান্বিত করছে।
র্যাডিকাল রাইট দল দার্শনিক রুশোর ‘সর্বসাধারণের ইচ্ছা’কে (Will of all) প্রাধান্য দেয়, যেখানে আধুনিক উদার গণতন্ত্র রুশোর ‘সাধারণের ইচ্ছা’ (General will) বা সকল জনগণের প্রকৃত ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। এভাবে চলতে থাকলে ইউরোপের উদার গণতন্ত্রের গৌরব হয়ে উঠবে অতীত, রাষ্ট্র চলবে ফেইক ইন্টারেস্টের ভিত্তিতে, প্রকৃত জনগণের ইচ্ছার রাষ্ট্র হারিয়ে যাবে।
সূত্র: রোয়ার বাংলা