ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে ২৮ উপায়ে দুর্নীতি এবং বিদেশে প্রায় ৩০ লাখ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে। অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার (১ ডিসেম্বর) কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, প্রতিবেদনটি শিগগির জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হবে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিগত সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থনীতির বিভিন্ন খাত থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে।
শ্বেতপত্রে দুর্নীতির জন্য সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে ব্যাংকিং খাতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের পরে দুর্নীতির প্রধান খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ভৌত অবকাঠামো, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। প্রতিবেদনটি আরও জানায়, বিগত সরকারের শাসনামলে লুটপাটের অন্যতম প্রধান খাত ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাত, যা থেকে ব্যাপক পরিমাণে দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে।
কমিটি বিভিন্ন দলিলপত্র পর্যালোচনা ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিটি রোববার তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে। এই প্রতিবেদন তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়।
শ্বেতপত্রে দুর্নীতির যেসব প্রধান উপায়ের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে ব্যাংক দখল, ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি এবং অবাস্তব প্রকল্প বাস্তবায়ন।
এছাড়া, প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রভাবশালীরা কোনো প্রকল্পের প্রয়োজন না থাকলেও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে সেগুলোর অনুমোদন নিয়ে থাকতেন।
এতে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দলীয়করণ, স্বজন প্রীতি, বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই তাদের মেধা বা যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হত।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে দুর্নীতি আরেকটি উপায় হিসেবে প্রকল্পের জমি বিক্রি বাণিজ্যের কথা বলা হয়েছে, যার অংশ হিসেবে প্রকল্প অনুমোদনের আগে প্রকল্প এলাকায় দলের প্রভাবশালীরা আগে জমি কিনে রেখে পরে প্রকল্পে বিপুল অর্থ দিয়ে বিক্রি করে লুটপাট করত।
এছাড়া, প্রকল্পের সম্পদ ও অর্থের অপব্যবহারও দুর্নীতির আরেকটি প্রধান উপায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পের গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদ প্রভাবশালী কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দেওয়া হতো।
শ্বেতপত্রে দুর্নীতির আরেকটি উপায় হিসেবে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজারে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট গঠন করে অতিরিক্ত দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া, প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন অব্যাহতিমূলক কর নীতি অনুসরণ করা হয়েছে এবং সরকারি কাজ পাওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে, যা দুর্নীতির আরও একটি উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শ্বেতপত্রে আরও যেসব দুর্নীতির উপায় তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে— রাজনৈতিক নেতাদের সরকারি তহবিল ব্যবহার, তথ্য ফাঁস করে বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা প্রদান, যোগসাজশের ভিত্তিতে দুর্নীতি, শোষণমূলক দুর্নীতি, একচেটিয়া বাজার দখল, তথ্য গোপন করে দুর্নীতি, পদোন্নতির জন্য দুর্নীতি, কমিশন ভাগাভাগি, রাজনৈতিক আনুকূল্য পেতে দুর্নীতি, এবং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দুর্নীতি।