নিউজ ডেস্ক:
রাজধানীর পূর্ব আশকোনার সূর্য ভিলার জঙ্গি আস্তানা থেকে চার মাস ধরে সারা দেশে নব্য জেএমবির কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। জঙ্গি কার্যক্রম গতিশীল করতে এখানেই বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন করা হতো। এমনকি এই আস্তানায় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
গত শুক্রবার দিবাগত রাত ২টার দিকে আশকোনার ৫০ নম্বর সূর্য ভিলায় জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। ‘অপারেশন রিপল ২৪’ নামের ১৬ ঘণ্টার অভিযানে এক কিশোরসহ দুজন নিহত হয়। আহত হয় সাত বছর বয়সি শিশু সাবিনা ওরফে আফিফা। এ সময় দুই শিশুসহ দুই নারী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করে।
এ ঘটনায় রোববার রাত ১০টায় দক্ষিণখান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করা হয়। মামলায় আটজনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলো- তৃষা মণি ওরফে উম্মে আয়শা (২২), তার স্বামী মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা, নিহত জঙ্গি জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা ওরফে সুমাইয়া (৩৪), শাকিরা ওরফে তাহিরা (৩৫), নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরীর ছেলে আফিফ কাদেরী ওরফে আদর (১৪), রাশেদুর রহমান ওরফে সুমন (২৪) মো. সেলিম (২৬) ও মো. ফিরোজ (২০)।
মামলার এজাহার সূত্রে আরো জানা যায়, নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাইনুল ইসলাম মুসা চার মাস আগে সূর্য ভিলার নিচতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। এই ফ্ল্যাটেই সুমন, সেলিম, ফিরোজসহ আরো কয়েকজন নব্য জেএমবির সদস্যকে নিয়ে সারা দেশে কীভাবে নব্য জেএমবির কার্যক্রম গতিশীল করা যায়, সে ব্যাপারে বৈঠক করত। তারা প্রায়ই এই বাসায় একত্র হতো। তা ছাড়া, এখানে নাশকতার জন্য সংগঠনের সদস্যদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
এজাহারে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলে রোববার ১৭টি ও শনিবার বিকেলে দুটি তাজা গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করা হয়। ম্যাগাজিনে এক রাউন্ড গুলিভর্তিসহ জাপানে প্রস্তুতকৃত একটি নাইন এমএম পিস্তল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পাঁচ রাউন্ড গুলিভর্তি দুটি ম্যাগাজিনসহ দুটি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। দুটি পোড়া ল্যাপটপ, একটি মোবাইলের পোড়া অংশ, পুড়ে যাওয়া প্রায় ১২ লাখ টাকা, কিছু স্প্লিন্টার, কিছু তার ও কিছু ধাতব বল উদ্ধার করা হয়। এ সময় কেমব্রিজ অ্যাডভান্সড লার্নার্স ডিকশনারি উদ্ধার করা হয়, যার ভেতরে কাগজ কেটে ছোট অস্ত্র রাখার চেম্বার তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে আত্মসমর্পণের সময় জেবুন্নাহার শিলার কাছ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি ৭ দশমিক ৬৫ এমএম পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন, তৃষার কাছ থেকে একটি কাঠের বাঁটসহ ১২ দশমিক ৫ ইঞ্চি একটি একপাশে ধারালো ছুরি উদ্ধার করা হয়, যার ওপর ইংরেজিতে ‘এস ২০০৫’ লেখা ছিল।
সূত্র জানায়, সিটিটিসি জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রাখার পর থেকেই তৃষা বারবার চিরকুট লিখে পাঠিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করে। চিরকুটের মাধ্যমে ভেতরে থাকা জঙ্গিরা আত্মসমর্পণের জন্য বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেয়। ঘরের ভেতর শিশু আছে বুঝতে পেরে পুলিশ কৌশল অবলম্বন করে। তারা চিরকুট দেওয়ার পর কয়েক দফা একজন পুরুষ ও নারীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে। কিন্তু ওই নারী ও পুরুষ আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায়। তারা নিজেদের আত্মঘাতী হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং যেকোনো সময় কোমরে বাঁধা সুইসাইড ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটাবে বলে হুমকি দেয়।
সূত্র জানায়, ভেতরে থাকা আফিফ কাদেরীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য কারার জন্য কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। এ সময় অফিফ ভেতর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে সোয়াত সদস্যরা জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে ‘প্লক’ পিস্তল থেকে ২৬ রাউন্ড, ‘এম ফোর’ রাইফেল থেকে ৩৫ রাউন্ড, ‘গ্যাস গান’ থেকে ৬ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এরপর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পুলিশের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
সিটিটিসির এডিসি ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘শুরু থেকে আমাদের চেষ্টা ছিল রক্তপাত ও গুলিবর্ষণ ছাড়া জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষ করা। এতে আমরা সফলও। কারণ, সকালে দুই শিশুসহ দুই নারী জঙ্গি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।’
তিনি বলেন, ‘জঙ্গি নির্মূলে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে পলাতক জঙ্গিদের ধরতে ইতিমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়েছে।’
আসামিদের পরিচয়
দক্ষিণখান থানায় দায়ের করা মামলায় আট জঙ্গি পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এদের মধ্যে তৃষা মণি ওরফে উম্মে আয়শার বাড়ি রাজশাহীর বাঘমারা উপজেলার সাঁইপাড়া। তার বাবার নাম আবদুস সামাদ, মায়ের নাম নাজমা বেগম। এজাহারে তার স্বামীর নাম লেখা হয়েছে মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা।
জেবুন্নাহার শীলা ওরফে সুমাইয়া ওরফে মারজুনের বাড়ি কুমিল্লা দক্ষিণ সদরের মধ্য ধনাইতরী। তার বাবার নাম হাজি মমিনুল হক মজুমদার ও মায়ের নাম জোহরা আক্তার চৌধুরী। তার স্বামী সম্প্রতি জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত প্রাক্তন মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে জাহাঙ্গীর আলম মুরাদ।
মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসার বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘমারা উপজেলার বুজরত কোলা গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত কামাল হোসেন ও মায়ের নাম সুফিয়া বেগম।রাশেদুর রহমান সুমন, মো. সেলিম ও নিহত শাকিরা ওরফে তাহিরার পরিচয় পাওয়া যায়নি।এ ছাড়া আফিক কাদেরীকে পুলিশ বিভিন্ন সময় তানভীর কাদেরীর ছেলে বললেও মামলার এজাহারে তাকে এবং বাবা-মাকে অজ্ঞাত বলা হয়েছে।