নিউজ ডেস্ক:
জিয়াবুল হক , টেকনাফ :
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৪ আগষ্টের পর থেকে এই পর্যন্ত সেনা- পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে দুই হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নারী.পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। শতাধিক গ্রামে গ্রামের কয়েক হাজার ঘরবাড়ী আগুনে জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছে। এখনো বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সুযোগে মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রয়েন্ট দিয়ে প্রতিনিয়ত স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পালিয়ে আসছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বেশির ভাগ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ক্যাম্প ছাড়া সীমান্ত দুই উপজেলার তাদের নিজস্ব আত্বীয়দের বাসায় এবং ভাড়া বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। এই রোহিঙ্গাদের এখন বড় ভরসা উখিয়া-টেকনাফের এবং বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে এগিয়ে আসা মানুষ। মানবতাবাদী এসব মানুষ সাধ্যমতো সহযোগিতা দিচ্ছে যাচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ও বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গাদের কেউ খিচুড়ি রান্না করে, কেহ নগদ টাকা, আবার কেউ কাপড়চোপড়সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, সবজিসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য বিতরণ করছে। বিতরণ করা হচ্ছে শুকনা খাবারও। ছুটে যাচ্ছেন আর্তমানবতার সেবায়দেশের বিভিন্ন শ্রেনীর পেশার লোকজন। তবে অনেকেরই প্রশ্ন, এই সহায়তার স্রোত যদি ফুরিয়ে যায় তখন কী হবে? কারণ প্রতিদিন খাবারের জোগান দিতে একেকজনের অনেক অর্থ চলে যাচ্ছে। গতকাল ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে ঢাকা থেকে আসা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লালবাগের বাসিন্দা রবিউল হাসানের নেতৃত্বে একদল টেকনাফ ষ্টেশনে কয়েকশত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের মাঝে নগদ ৫শত টাকা সহযোগিতা করার চিত্র দেখা যায়, ব্যবসায়ী রবিউল হাসান বলেন, ‘আমি কয়েক দিন ধরে আমার ব্যবসায়ী সহযোগিদের বলে আসছি নির্যাতিত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রান দিয়ে সহযোগি করব। পরে চিন্তা করে দেখি ত্রানতো অনেকে দিচ্ছে আমি নগদ টাকা দিলে তারা কিছু একটা করতে পারবে। তার আরো অনেককে দেখা যায় বিভিন্ন প্রকার পণ্য ও খাবার বিতরণ করতে।
সুত্রে জানা যায়, স্থানীয়ভাবেই শুধু নয়, প্রবাসে থেকেও অনেকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা জোগাচ্ছে। বর্তমানে সৌদিয়া, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে তাদের আত্বীয় স্বজনের কাছে ফোন করে ‘মা, বাবা, ভাইদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে বিভিন্ন জিনিস বিতরণ করে সহায়তা করার জন্য। ’ সন্তানদের এই আকুতি পেয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে বিভিন্ন প্রকার খাবার কিনে ছুটে যাচ্ছে।
নির্যাতিত রোহিঙ্গারা তাদের করুণ কাহিনী বর্ণনা দিচ্ছে::
বাংলাদেশে আসা শরনার্থীদের বর্ণনা অনুযায়ী রাখাইনে আইন- শৃংখলা বাহিনীর হাতে নিহত মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সেখানে একটি গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যার বর্নণা দিয়েছেন মংডুর নয়াপাড়া ও মেরুল্যা গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা। গতকাল ১১ সেপ্টেম্বর বিকালের দিকে টেকনাফ পৌরসভার ষ্টেশন এলাকায় তাদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মৌলভী মোহাম্মদ আলম জানিয়েছেন, তারা ২৬ আগষ্ট শনিবার এক সাথে চারজনের মৃতদেহ কবর দিয়েছেন। এরমধ্যে তিনজনকে এক কবরে আরও এক জনকে অপর একটি কবরে মাটি চাপা দিয়ে কোন মতে প্রাণ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। ওইদিন ভোররাতে সেনা পুলিশের প্রায় দেড় শতাধিক সদস্য নয়াপাড়া ও মেরুল্যায় গুলি করে। এই সময় প্রায় ৪৫জন যুবক ও কিশোর লাঠি সোটা নিয়ে তাদের প্রতিহত করতে জড়ো হয়। এসময় তাদের উপর এলোপাথাড়ী গুলি বর্ষণ করা হয়। যেখানে মেরুল্যা শিকদার পাড়ার চারজন এবং পূর্ব পাড়ার দুইজন নিহত হয়। আরো অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। মেরুল্যা গ্রামের হাসিম উল্লাহ জানান, আমাদের পাড়ার(পূর্ব পাড়া) যে দুইজন নিহত হয়েছে তাদের একজন আনিস ও আর একজন জুবায়ের, দুইজনের বয়স ২৫ বছরের কাছাকাছি। সকাল আটটা থেকে দুপুর পর্যন্ত তারা (সেনাবাহিনী) আমাদের গ্রামে ছিলো। গুলিতে বেশ কয়েকজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর সবাই গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ের দিকে লুকিয়ে যায়। তারা ( সেনা- পুলিশ) চলে যাওয়ার পর সবাই গ্রামে এসে আনিস ও জুবায়েরকে মৃত দেখতে পাই, আরো কয়েকজন ছিলো গুলিবিদ্ধ, তাদেরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের পাড়ার আনিস ও জুবায়েরকে এনে নুরুল হক মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়, তার আগে ওই মসজিদের ইমাম মাওলানা নুরুল হক তাদের জানাযা পড়ান, শতাধিক ব্যক্তি জানাযায় অংশ গ্রহন করেন। তাদের দুইজনকে এক কবরে রাখা হয়েছে। স্থানীয় আলেম মাওলানা মোশতাক আহমদ ফতোয়া দিয়েছেন মগ (মিয়ানমারের সেনা- পুলিশ) সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতরা শহীদ, তাদের গোসল ও কাফনের কাপড় ছাড়াই দাফন করা যাবে, সেই জন্য আমরা তাদের লাশের গোসল করায়নি, উল্লেখ করেন তিনি।
হাসিম উল্লাহ আরো বলেন, একই সময়ে পাশের শিকদার পাড়ায় একইভাবে মারা গেছে চারজন, তাদেরকে ওই গ্রামের শিকদার মসজিদের পাশে দাফন করা হয়, তাদেরকেও এক কবরেই মাটি চাপা দিতে হয়েছে। একসাথে জানাযা পড়িয়েছেন ওই মসজিদের ইমাম মৌলভী আলী আকবর। মেরুল্যা শিকদার পাড়ায় যে চারজন নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে রফিক ও জামালের নাম পরিচয় জানেন হাশিম উল্লাহ। ওই চারজনের জানাযা ও কবর দেয়ার সময় সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। এই ছয়জমের মৃত্যু ও দাফনের অনুরুপ বর্ণনা দিয়েছেন মেরুল্যা পুর্ব পাড়ার বাসিন্দা আবদুর রহিম। তিনিও প্রাণ ভয়ে আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজার জেলার টেকনাফে।
আবদর রহিম বলেন, আনিস ও জুবায়েরকে দাফনের পর ঘরে চলে আসি, ভয়ে পাশের পাড়ায় যায়নি সেখানে এক সাথে চারজনকে কবর দেয়া হয়েছিলো। আনিস আমার কাছে পানি চেয়েছিলো মেরুল্যা পুর্ব পাড়ার হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থলে ছিলেন হাসিম উল্লাার ছেলে মংডুর একটি স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মোহাম্মদ ইউসুফ। আনিস তার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলো বলে জানিয়েছেন। মিয়ানমার থেকে আনা মোবাইল ফোন সেটে আনিসের ছবি দেখিয়ে ইউসুফ জানান, ও আমার স্কুলের বন্ধু, আমরা এক সাথে পড়ালেখা করেছি। ২৪ আগষ্ট শুক্রবার সকালে সেনাবাহিনী দেখে আমরা সবাই বাজারের মুখে জড়ো হয়েছিলাম, গাড়ী থেকে নেমেই তারা গুলি করতে করতে গ্রামে ডুকে পড়ে, আমি ও আনিস পাশাপাশি ছিলাম, আনিসের বুকে ও মাথায় গুলি লাগলে সে পড়ে যাওয়ার সময় আমি তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম, সে আমার কাছে পানি ছেয়েছিলো, কিন্তু আমি তাকে পানি দিতে পারিনি, জুবায়ের আমার থেকে একটু দূরে ছিলো, গুলির তোড়ে হামাগুড়ি দিয়ে আরো কয়েকজনসহ গ্রামের ভিতরে চলে আসি, নিহত ও আহতরা সেখানেই পড়ে ছিলো। মোহাম্মদ ইউসুফ জানায়, কয়েক ঘন্টা পর গ্রামবাসীরা সবাই মিলে তাদের দুইজনকে নিয়ে আসে, তখন তারা মরে গেছে, আনিসের মাথায় ও বুকে গুলি লেগেছিলো, যখন গ্রামের ভিতর লাশ আনা হয় তখন তার গলা ও মুখে কাটা চিহ্ন ছিলো। মোহাম্মদ ইউসুফ আরো জানায়, তারপরের দিন অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে. আমরা আরো দুই একদিন ছিলাম, গ্রামের ১৫/২০জনের মত গুলিবিদ্ধ ছিলো, আত্মীয় স্বজনরা তাদের নিয়ে কি করবে বুঝতে পারছিলোনা, পাড়া থেকে তাদের বের করা যাচ্ছিলোনা, কারণ রাস্তার মুখে মিলিটারী ও পুলিশ অবস্থান নিয়ে ছিলো। তারা প্রথমদিন ( শুক্রবার) গ্যাস লাঞ্চার মেরে কয়েকটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো, অন্য আর একটি পাড়ায় গিয়ে আমরা দুই দিন ছিলাম, আবার পাড়ায় এসে থাকার চেষ্টা করলেও পাশের গ্রামে আবারো আগুন দেওয়াতে আর থাকতে পারিনি, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে আসতে হয়েছে, জানাই ইউসুফ। এটাই গনহত্যা ২৫ আগষ্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। অনেকেই আহত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে চিকিৎসা নেয়ার জন্য যাদেও মধ্যে মারা গেছে কমপক্ষে ১০ জন। তাছাড়া নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে আসার সময় নৌকা ডুবে মারা যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৭২ জনের লাশ বাংলাদেশ উপকুলে উদ্ধার করা হয়েছে। নৌকা ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ আছে আরো বহু রোহিঙ্গা মুসলমান। কয়েক দশক ধরে চলছে এই পরিস্থিতি। এর আগে গত বছর অক্টোবরে চালানো দমন পীড়নেও ৩শ থেকে ৪শ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গত ২৩ অক্টোবর প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের বিশেষ মিলিশিয়া বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ কনভেশন অনুযায়ী মোট পাঁচ ধরনের অপরাধ ঘটলে তা গনহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। হিউম্যান রাইট ওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়েছে গনহত্যার পর্যায়ে পড়ে এরকম পাঁচটি অপরাধের মধ্যে চারটি রাখাইন রাজ্যেও রোহিঙ্গাদের উপর চালানো হয়েছে।
২৫ আগষ্ট থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা গত বছর অক্টোবরে চালানো ধ্বংসযজ্ঞের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্নণায় তা স্পষ্ট। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নির্যাতন নিয়ে গবেষণারত উখিয়া মহিলা কলেজের অধ্যাপক নুরুল আমিন সিকদার ভুট্রো বলেছেন, বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষরা রাষ্ট্রীয় মদদে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি, ক্ষেত্র বিশেষে এই ধ্বংসযজ্ঞ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে যেটা ধারণা করা যাচ্ছে তা হলো তাদেরকে নির্মূল করার জন্য পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে, পালিয়ে আসা বেশির ভাগ রোহিঙ্গায় নির্বিচারে গুলি চালানোর কথা জানিয়েছে, তাদের অনেকেই স্বজন হারিয়েছে। এছাড়াও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যাতে তাদের বাড়ী ঘরে ফিরতে না পারে সেই জন্য সব ধরনের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, উল্লেখ করেন তিনি। সংঘাত শুরুর আগেও সেখানে তাদের উপর মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, খাদ্য ও শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদা পূরনে বাঁধা দেয়া হয়েছে, এসব কিছুই মানবতা বিরোধী অপরাধের পর্যায়ের পরে। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারের সেনা-পুলিশ গ্রামে ঢুকে মর্টার ও লাঞ্চার দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটছে, নিরস্ত্র মানুষজনের উপর এভাবে হামলা নজির রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা ছাড়া অসম্ভব।
গত বছর অক্টেবরের সংঘাতের পর জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সেখানে ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়ে তদন্ত চালানোর চেষ্টা করলেও মিয়ানমার সরকার তাতে সাড়া না দিয়ে তদন্ত দলের সদস্যদেরকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে।