নিউজ ডেস্ক:
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুর। ছোট ছোট পাহাড় ও নদীর সমন্বয়ে গড়া শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় রয়েছে শুল্ক স্টেশন ‘নাকুগাঁও’।
এখন পর্যন্ত এর অর্থনৈতিক পরিসর খুব বড় না হলেও কৌশলগত কারণে শুল্ক স্টেশনটির অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকার এরই মধ্যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আর ওই সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই খুলে যাবে রাজস্ব সম্ভাবনার নব দ্বার। যদিও ২০১০ সালে পূর্ণাঙ্গ শুল্ক স্টেশন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল নাকুগাঁও। তবে এখনো এর যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হয়নি। অথচ সারা দেশে সক্রিয় ১০টি স্থলবন্দরের মধ্যে নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশন অন্যতম। যদিও কাগজে-কলমে বর্তমানে দেশে ২৩টি স্থলবন্দর রয়েছে।
নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশনটির আমদানি-রপ্তানি ও রাজস্ব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারের নেওয়া বেশ কিছু উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে, এ স্টেশনকে ব্যবহার করে ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধা নেওয়া, স্টেশনের আশপাশে শেরপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশনের ভারতীয় ডালুর অংশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে কূটনৈতিক উদ্যোগ, শুল্ক স্টেশন স্থাপন ও আমদানি-রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
এসব সমন্বিত উদ্যোগ যথাযথভাবে কার্যকর করা হলে একদিকে রাজস্ব আহরণ যেমন বাড়বে, তেমনি সুযোগ সৃষ্টি হবে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে স্টেশনটির কর্মক্ষমতা ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখনো চলমান রয়েছে অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ।
নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশন সূত্র জানায়, বর্তমানে ভারতের মেঘালয়সহ কয়েকটি রাজ্য থেকে কয়লা, পাথর, গবাদিপশু, ফলমূল, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, টিম্বার, চুনাপাথর, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, বল ক্লেসহ ১৭টি পণ্য এ বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে কয়লা ও পাথর বেশি পরিমাণে আমদানি হয়। এ ছাড়া সিমেন্ট, শাড়ি, গার্মেন্টস পণ্য, মশারিসহ বেশ কয়েকটি পণ্য রপ্তানিও হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় দিন দিন রাজস্ব আহরণ বাড়ছে। ১৭টি পণ্যের আমদানি ও সব পণ্যের রপ্তানি সুবিধা থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে কয়লা ও পাথর আমদানির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, এ শুল্ক স্টেশন থেকে গত অর্থবছর ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকার রাজস্ব আহরিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকার রাজস্ব আহরিত হয়েছে। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে ও আমদানি-রপ্তানি বাড়লে রাজস্ব কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করে ৩০ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে। নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণার পর ১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১৩ দশমিক ৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ৪০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার একটি ওয়্যারহাউজ, ১০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার একটি ওয়িং ব্রিজ, ১০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার একটি ওপেন ইয়ার্ড, পার্কিং ইয়ার্ড, সীমানাদেয়াল, বিদ্যুৎ, অফিসসহ উন্নয়ন করা হয়।
এ বিষয়ে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট (ঢাকা উত্তর) এর কমিশনার মাসুদ সাদিক বলেন, ‘১৯৯৭ সালে নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশন হিসেবে কাজ শুরু। কৌশলগত কারণে এ স্টেশনের সম্ভাবনা খুবই বেশি। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে এ স্টেশনে ৩০০ ট্রাক পার্কিং সুবিধা, ১০০ টন ক্ষমতার একটি ওয়িং স্কেল স্থাপন করা হয়েছে। ১৭টি পণ্যের আমদানি ও সব পণ্যের রপ্তানি সুবিধা থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে কয়লা ও পাথর আমদানির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সিমেন্ট, তাঁতের শাড়ি ও প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানিতে এ স্টেশনের অভাবনীয় সম্ভাবনা থাকলেও তা পরিপূর্ণ ব্যবহার করা হচ্ছে না। দুদেশের সড়ক যোগাযোগসহ আরো কিছু উন্নয়ন হলে এ স্টেশনের পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হবে। রাজস্ব আহরণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে।
কথা হয় স্থানীয় আমদানিকারকের প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৭টি পণ্য আমদানির সুযোগ থাকলেও মাত্র দুটি পণ্য আমদানি হয়। ১৭ এপ্রিলের পর ভারতের নিষেধাজ্ঞার ফলে তাও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। বৈধভাবে সকল পণ্য এ স্টেশন দিয়ে আমদানি করা হলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়বে, বাড়বে রাজস্ব।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (হিসাব) গাজী মো. আলী আকবর এ বিষয়ে বলেন, এ অঞ্চলের ব্যবসার সম্প্রসারণে এ স্টেশন ভূমিকা রাখছে। অবকাঠামোসহ ভবিষ্যতে আরো সুবিধা বৃদ্ধির ফলে এ স্টেশনের রাজস্ব আহরণ বেড়ে যাবে। নাকুগাঁও স্থলবন্দর পুরোপুরি কার্যকর হলে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
ওই অঞ্চলের রাজস্ব সম্ভাবনা সরেজমিনে পরিদর্শন করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল।
পরিদর্শন শেষে ১৮ মার্চ নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এনবিআর অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় শেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার বলেন, ‘ট্রানজিট হলে ভুটান থেকে এ স্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানি করা যাবে। এ ছাড়া শেরপুর-জামালপুর রেল সংযোগ হলেও এ স্টেশনে আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যাবে। এ স্টেশনের ফলে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। শেরপুরে আরো বেশি শিল্প স্থাপন হলে এখান থেকে পণ্য এ স্টেশন দিয়ে রপ্তানি হবে, রাজস্ব বাড়বে।’
এনবিআর সদস্য ফরিদ উদ্দিন (শুল্কনীতি) সভায় এ বিষয়ে বলেন, এ স্টেশনের ভারতীয় অংশে শুল্ক স্টেশনসহ অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাবে। ফলে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে, বাড়বে রাজস্ব। এ স্টেশনকে আরো গতিশীল করার জন্য অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডসহ অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘নাকুগাঁও স্টেশনের রাজস্ব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এনবিআর কাজ করবে। ব্যবসায়ীদের মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়ে কাজ করবে। আগামী মাসে ভারত থেকে কাস্টমসের উচ্চপর্যায়ে একটি প্রতিনিধিদল আসবে। নাকুগাঁওয়ের সঙ্গে ডালু স্টেশনের সম্পর্ক কীভাবে ঘনিষ্ঠ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।