নিউজ ডেস্ক:
ফুল ভালোবাসেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সবাই কমবেশি ফুল পছন্দ করেন। কেননা, ফুলের সুঘ্রাণ সবাইকে আকৃষ্ট করে। ফুলের সুগন্ধ মানুষকে মুগ্ধ করে বলেই এর প্রতি মানুষের এই টান। পৃথিবীজুড়ে নানা প্রজাতির ফুল রয়েছে।
এসবের মধ্যে এমন একটি ফুল রয়েছে যা মানুষকে আকৃষ্ট করে না, বরং এর উৎকট পঁচা গন্ধের কারণে মানুষ এই ফুলের ত্রিসীমানাও ঘেঁষতে চায় না। এর নাম ‘মৃতদেহ ফুল’। যদিও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন Amorphophallus titanum। ফুলটি প্রস্ফুটনের সময় মৃতদেহের ন্যায় উৎকট পঁচা গন্ধ ছড়ায় বলে ‘মৃতদেহ ফুল’ নামেই এটি বেশি পরিচিত।
শাখা-প্রশাখাবিহীন রক্তিম লাল পাপড়ি ও হলুদ-সবুজ মিশ্রিত মঞ্জরি বিশিষ্ট এই ফুলটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুল হিসেবে স্বীকৃত। এর আকার হয়ে থাকে সাধারণত ৩ থেকে ৪ ফুট।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে ফুলটি পরায়ন শুরু করে, ছড়াতে থাকে মাংস পঁচা গন্ধ। এর দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ক্যারিয়ন বিটল (গোবরে পোকা) নামে এক ধরনের পোকা ফুলের পরাগ রেনু নিতে এর গোড়ায় ভিড় জমায়। সেখান থেকে পরাগ রেনু নিয়ে স্ত্রী মৃতদেহ ফুলের কাছে পৌঁছে দেয় এই পোকাগুলো। এভাবে বংশবিস্তার করে ফুলটি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ফুলটি সন্ধ্যা থেকে গন্ধ ছড়াতে শুরু করে সারারাত তা ছড়ায়, আর ভোর হলেই বন্ধ করে দেয় গন্ধ ছড়ানো। এভাবে মাত্র ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে এই পরাগ রেনু ছড়ায় ফুলটি। এরপর নষ্ট হয়ে যায়।
তীব্র পঁচা গন্ধ সত্ত্বেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বোটানিক্যাল গার্ডেনের গ্রিন হাউজে জড়ো হয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ। দিনটি ছিল ২৯ জুলাই, ২০১৬ (শুক্রবার)।স্থানীয়ভাবে জুলাই মাস প্রচণ্ড গরমের মাস হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এদিন সন্ধ্যায় অসহ্য ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করেও গ্রিন হাউজে ভিড় জমিয়েছিল ওই এলাকার পাঁচটি অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ।
উদ্দেশ্য, একটি মৃতদেহ ফুলের প্রস্ফুটন দৃশ্য দেখবেন। উৎকট পঁচা গন্ধ জেনেও সেখানে জড়ো হয়েছিলেন তারা। ফুলটির সঙ্গে এ সময় সেলফি তুলেছেন কমপক্ষে ২৫ হাজার দর্শনার্থী। কেননা, এই ফুলের প্রস্ফুটন একটি বিরল ঘটনা। কারণ, প্রস্ফুটনের জন্য পরিপূর্ণতা পেতে এই ফুলের সময় লাগে ৫ থেকে ১০ বছর।
মৃতদেহ ফুল প্রস্ফুটনের ঘটনা বিরল হলেও ২০১৬ সালে রেকর্ড সংখ্যক প্রস্ফুটন ঘটেছে এই ফুলের। ২০০০ সালের আগে এক শতাব্দীজুড়ে এই ফুলের প্রস্ফুটন হয়েছে ৫০টির মতো। কিন্তু শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই পরাগায়ন হয়েছে ৩২টি ফুলের, যার অধিকাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। নিউইয়র্কের ফুলটির প্রস্ফুটনের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ইন্ডিয়ানা, ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলিনা, উইসকনসিন, ডিস্ট্রিক্ট অব কলোম্বিয়া, কলোরাডো, মিসৌরি, হাওয়াই, ওয়াশিংটন, নিউ হাম্পশায়ার ও মাসাচুসেটস-এ পরাগায়ন ঘটেছে এই ফুলের। এছাড়াও প্রায়ই একই সময়ে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম ও যুক্তরাজ্যেও ফুটেছে এই ফুল।
২০১৬ সালে এত সংখ্যক এই বিরল প্রকৃতির মৃতদেহ ফুলের একই সময়ে প্রস্ফুটনের ঘটনা বিস্মিত করেছে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের। তাদের মতে, যে ফুল একবার পরাগায়ন ঘটাতে সময় নেয় ৫ থেকে ১০ বছর, গত এক শতাব্দীজুড়ে যার প্রস্ফুটনের ঘটনা মাত্র ৫০টির মতো, সেই ফুলের প্রায় এক সঙ্গে এতগুলো পুষ্পায়ন সত্যি অবিশ্বাস্য।
নিউইয়ক বোটানিক্যাল গার্ডেনের গ্রিনহাউজের পরিচালক মার্ক হাচাদৌরিয়ানের মতে, এই ফুলটি সাধারণত উষ্ণ ও গ্রীষ্ম প্রধান এলাকায় জন্মে। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যগুলোয় যেহেতু উষ্ণ, শুষ্ক ও বর্ধিত গ্রীষ্মকাল বিরাজমান। সে কারণেই হয়তো এই রাজ্যগুলোতে ফুলটির গণপ্রস্ফুটন ঘটেছে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, বাঁশের চারা যখন প্রস্ফুটনের সময় হয়, তখন আমরা দেখতে পাই একই সঙ্গে অনেকগুলো চারা প্রস্ফুটিত হচ্ছে।
এছাড়াও তিনি বলেন, জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও চাঁদের ঘূর্ণায়ন ইত্যাদির আমূল পরিবর্তন কারণেও এই গণপ্রস্ফুটনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এই ফুলগুলো যেহেতু মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণতায় পরাগায়ন ঘটায়, বর্তমানে পৃথিবীপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবেও এমনটি ঘটে থাকতে পারে।
তবে তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে গবেষণা শুরু হলেও তা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। যেহেতু ফুলটি পরাগায়নে দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকে এবং মাত্র কয়েকঘণ্টার পরাগায়ন প্রক্রিয়া শেষে আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তাই গবেষণা কার্যক্রম আরো অগ্রগতি আনাটাও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
জলবায়ু, পরিবেশ ও মৃতদেহ ফুলের পরাগায়নের মধ্যে আসলে কি ধরনের সম্পর্কে বিদ্যমান তা কেবল এই ফুলই বলতে পারবে। এখনো নিশ্চিত করে বলার মতো সময় আসেনি, উল্লেখ করেন হাচাদৌরিয়ান।