নিউজ ডেস্ক:বেহুলা-লক্ষীন্দরের নাম নিয়ে গানের তালে তালে কবিরাজি পদ্ধতিতে মেহেরপুরের একটি গ্রামে এক পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর চিকিৎসা চলছে। অন্ধত্ব ও সর্প দেবীর অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতেই নাকি এ আয়োজন করা হয়েছে বলে লোকমুখে জানা গেছে। এ গানকে বেহুলা-লক্ষীন্দরের পালাগান বলছেন গ্রামের অনেকেই। ঝাড়ফুঁক আর দোয়াসহ আজব এ চিকিৎসা পদ্ধতি চলছে তিন দিন ধরে। এ চিকিৎসা দেখতে অনেক মানুষের ভিড়ও লক্ষ করা গেছে। লক্ষীন্দরের পালাগান আর আজব এ চিকিৎসা পদ্ধতি উপলক্ষে গ্রামে বসেছে মেলা।
জানা গেছে, মেহেরপুর সদরের হিজুলী গ্রামের আব্দুল মাবুদ (৫৯) দুই বছর আগে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। পুরোনো বাড়ি ভাঙার সময় একটি গর্তে ৪০টি ছোট-বড় সাপ দেখতে পান তিনি। সে সাপ মারার পরই তাঁর স্ত্রী অন্ধ হয়ে যান বলে জানান আব্দুল মাবুদ। এমন কী তাঁর স্ত্রীর মাথার চুলে এক রাতে জটও বাঁধে বলে তিনি জানান। বিভিন্ন চিকিৎসক ও হাসপাতালে আব্দুল মাবুদ তাঁর স্ত্রীকে চিকিৎসা করিয়েছেন, এতেও তাঁর স্ত্রী দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাননি এবং চুলের জটও ভালো হয়নি বলে তিনি জানান। এ ছাড়া অব্দুল মাবুদকে প্রতি রাতেই মৃত সাপ তাড়া করে বেড়াচ্ছে, এমন স্বপ্ন্ও দেখেন তিনি। তাঁর চাষাবাদে নাকি ক্ষতি লেগেই আছে। তাই আব্দুল মাবুদ সাপের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতেই লক্ষীন্দরের পালাগানসহ এ চিকিৎসার আয়োজন করেন।
সরেজমিনে গতকাল বুধবার সকালে হিজুলী গ্রামে আব্দুল মাবুদের বাড়িতে গেলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এর আগে গত সোম ও মঙ্গলবার প্রকাশ্যেই তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আবদুল মাবুদের বাড়ি থেকে সামান্য কিছু দূরুত্বে গ্রামের মাস্টার ইমাদুল হকের আগবাগানে দেখা যায় ব্যাপক আয়োজন। এখানেই বাঁশ দিয়ে ঘিরে মাটিতে পাটি পেতে মঞ্চ করা হয়েছে। সেই মঞ্চে অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পালাগান পরিবেশন করছেন আব্দুল জব্বারের দল এবং এখানেই ওই দুই রোগীকে রেখে চিকিৎসা করা হচ্ছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কাব্য মনসামঙ্গল কাব্যের বিভিন্ন অংশবিশেষ এখানে চিকিৎসার মন্ত্র হিসেবে পড়ছেন কবিরাজ। সেটিকে বেদবাক্য মানছেন রোগীসহ গ্রামের সাধারণ মানুষেরা। এমন বিশ্বাসে হিজুলী গ্রামের কৃষক আব্দুল মাবুদ রোগমুক্ত হতে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে তিন দিন ধরে গ্রামে আয়োজন করেছেন এ পালাগানের চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে গত তিন দিনে রোগীর কোনো উন্নতি লক্ষ করা যায়নি।
বেহুলা-লক্ষীন্দরের পালাগানের দলপ্রধান আব্দুল জব্বার বলেন, ‘বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে বাড়ির মালিক ৪০টি সাপ মেরে ফেলেছেন। সেই কারণেই পরিবারটির ওপর অভিশাপ নেমে এসেছে। সেই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতেই আমরা মনসা দেবীকে সন্তুষ্ট করতে তিন দিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি। যাতে তিনি মুগ্ধ হয়ে অভিশাপ তুলে নেন।’ তিনি আরও বলেন, গরুর বাছুর না হলে বাছুর হওয়া, সন্তান লাভ, রোগ-ব্যধির উপশম, অধিক ফসল উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি এমন সাত ধরনের মনোবাসনা পূরণে তাঁর দল পালাগান পরিবেশন করে থাকে।
আয়োজক আব্দুল মাবুদের ছোট ভাই আবদুস সালাম জানান, তাঁর ভাবির মাথায় ব্রেন টিউমার হয়েছে। সে কারণেই তিনি চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু তাঁর ভাই মাবুদ মনে করেন, বাড়ি করার সময় সাপ মারার কারণেই ভাবি অন্ধ হয়ে গেছেন। এ কারণেই শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি এই চিকিৎসা করাচ্ছেন।
চিকিৎসা পদ্ধতি দেখতে আসা গ্রামের রাহাতুল হোসেন বলেন, হিন্দুধর্মমতে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে চিকিৎসা করানো ঠিক হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন অলোক কুমার দাস জানান, মনসাপালা ও তাবিজ-কবজের চিকিৎসা পদ্ধতি আসলে একটি অপচিকিৎসা। অজ্ঞতার কারণেই অনেক মানুষ এটিকে বিশ্বাস করেন। এ ধরনের চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত নয়।