রাতের অন্ধকারে গলা খাকারির আওয়াজ পেয়ে মুনাফ আলীর পোয়াতি বউয়ের তন্দ্রাচ্ছন্নতা নিমেষেই কেটে যায়।
এত রাতে কেউ এলো কি না ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। রাতের বেলা কারো আসার কথা নয়। এই খারাপ সময়ে অন্ধকারকে সবাই ভয় পাচ্ছে। গ্রামজুড়ে ভয় উঁকিঝুঁকি মারছে প্রতিনিয়ত। তাই এই রাতে কেউ আসুক এটা মুনাফ আলীর বউ রমিজার মনোবাসনা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্বামীর ঘরছাড়া হওয়ার পর থেকে এই কটা দিন তার চোখে ঘুম নেই। রাতের বেলা চোখে তন্দ্রা আসতে না আসতেই কারো গলা খাকারির শব্দে তার ঘোর কেটে যায়। কেউ এসে তাকে স্বামীর খবর দিয়ে যাবে এমন একটা আশা বুকের ভেতর দানা বাঁধতে শুরু করে।
কেউ আসেনি এখনো খবর নিয়ে। কিন্তু স্বামী দেশে থাকার সময় প্রায় প্রতিরাতে অনেক চেনা-অচেনা লোকজনকেই আসতে দেখেছে। তার নিরীহ স্বামীকে কী সব উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে কেউ মাথা নষ্ট করে দিয়ে গেছে।
কিছুদিন ধরে স্বামীর মতিগতি বুঝতে না পেরে বাণ-টোনা কাটানোর চেষ্টা যে করেনি তাও নয়। তার মাকে দিয়ে সালামত ফকিরের পানিপড়া আনিয়েছে। সাতদিন ধরে ফকিরের পড়ানো ডাবের পানি সকালে মাঠে যাওয়ার আগে স্বামীকে খেতে দিয়েছে। অনেক দেন-দরবার করে হাতে তাবিজ লাগানোর চেষ্টা করে সফলও হয়েছে। কিন্তু স্বামীর ভিনদেশে যাওয়া থামাতে পারেনি।
গভীর রাতে স্বামীর কাছে গিয়ে আবদার করেছে। পায়ের কাছে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করে না যেতে নিষেধ করেছে।
স্বামীর মন ভেজাতে পারেনি কোনো কথায়।
উল্টো মুনাফ আলী ধমকায়, ‘আঁর মন যে শেখ সাহেবঅর ডাকে যুদ্ধত যাইতু চায়, তোর ভালা ন লাগেদ্দে না? দেশঅর ডাকে সাড়া দিয়্যন ফরজ।’
রমিজা ফুঁপিয়ে কাঁদে, ‘ফরজ তো আরঅ আছে। দাঙ্গার মইধ্যি যওন ফরজ অইয়্যিদে না? আঁরার কথা বিচার ন গরি যাইব্যেন ক্যানে?’
বাতাসের ধাক্কায় ঘরের চালায় ফরফর আওয়াজ হয়। বউয়ের বুকের ভার নামানোর দায়িত্ব মুনাফ আলী নেয় কি না রমিজা বুঝতে পারে না। রমিজা অভিযোগ করে বলে, ‘চেয়ারম্যানঅর মাইনষ্যে মাথা বিগড়াই দিয়্যিদে অঁনঅরার। বড়লুকঅর কথা ফুনি বউ-পোয়া ছাড়ি অঁনএ যাইত ন ফারিবেন।’
বউয়ের পেটে হাত দিয়ে মুনাফ আলী খানিকটা ধন্দে পড়ে। পোয়াতি বউয়ের কান্না তার মাথায় শোরগোল যে তোলে না তা নয়। বরং যন্ত্রণা বাড়ায়। অস্থিরতা বাড়ায়। কিন্তু রমিজা সেই অস্থিরতার সুযোগ নিতে পারে না। স্বামীর মনে চূড়ান্ত আঘাত করতে পারে না। তার নিরক্ষর মনের সব কথা মুনাফ আলীকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে পারে না।
রমিজা দেশ নিয়ে ভাবে না। তার ভয় ইজ্জতের। পাকিস্তানি ফৌজের ভয়। তারা মেয়েদের ইজ্জতে হাত দিয়েছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে আমোদ-ফূর্তির যে হোলিখেলায় মেতে উঠেছে তা সহজে থামবে কি না কেউ জানে না। মেয়েদের ইজ্জতের কানাকড়ি দামও তাদের কাছে নেই। মানুষের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। মানুষ পোড়াচ্ছে। লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞের উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে তারা।
তবু রমিজা ভাবে, ঘর পোড়ানো আর মা-বোনের ইজ্জতে হাত দেওয়া এক নয়। তারাও মুসলমান। মুসলমান হয়ে এমন জেনার কাজ কী করে পাকিস্তানের আর্মিরা করে রমিজার মাথায় ঢোকে না। স্বামীর অপমানের কথা শুনে তার বুক কেঁপেছে। কিন্তু সামান্য লুঙ্গি খুলেই যে তাকে খালাস দিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা, এতে মা’বুদের দরবারে হাজার শুকরিয়া। জানে তো মারে নাই।
তবু স্বামীকে সে বোঝাতে পারে না। মুনাফ আলী ফুঁসে ওঠে, ‘হারামির পুতঅক্কল আঁর দেশঅত আইয়্যেরে ইজ্জত লই টানাটানি গরিবু, এই সাহস ক্যানে ফাইয়্যি?’
‘দেশঅর মানুষ খালি তুঁই না? চোখ বুজি থাকিলেই তো অয়।’ রমিজা স্বামীর ক্ষোভ কমানোর চেষ্টা করে।
মুনাফ আলী উত্তর দেয়, ‘চোখ আল্লাই দিয়্যি দে দুনিয়াদারি দেখিবেল্লাই। হালাল-হারাম পরখ গরিবেল্লাই। মানুষঅর ভালা গরিবেল্লাই।’
স্বামীর কথার ওপর আর কিছু বলার সাহস পায় না রমিজা। তার বুকের ধরফরানি আরো বাড়ে। এত রাতে কেউ সত্যিই গলা খাকারি দিল কি না বোঝার চেষ্টা করে। চেয়ারম্যানের ওপর অকারণে ক্ষোভ জমা হয়। চেয়ারম্যানের প্ররোচনায় পড়ে তার স্বামী এমন অবিবেচনার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘরে অসহায় বউকে রেখে, অসুস্থ বাপকে আল্লাহর কাছে হাওলা করে তার স্বামী ভারতে গেছে। এটা কোনো ধরনের বিবেচনা চেয়ারম্যান করলো? গ্রামে লোকের অভাব নাই। দেশের ভালো-মন্দ দেখার তো আরো লোক আছে।
মধ্যরাতে রমিজার বুকে তোলপাড় শুরু হয়। স্বামীর জন্য মন কাঁদে। আল্লাহ কোন হালতে স্বামীকে রেখেছে সেই চিন্তায় চোখের ঘুম হাওয়া হয়ে যায়। আর কতদিন এভাবে কাটাতে হবে মা’বুদ জানে।
পাশের ঘর থেকে শ্বশুরের নাক ডাকার শব্দ কানে আসছে। বাঁশের বেড়া দিয়ে কক্ষগুলো আলাদা করা হয়েছে। তার শ্বশুর অবস্থাসম্পন্ন কৃষক না হলেও তাদের ভাত-কাপড়ের অভাব নেই। নিজেদের কিছু ধানি জমি আছে। বর্গা জমিতেও ধান চাষ করে। পোনা ধরার মৌসুমেও আয় মন্দ হয় না। তার স্বামী ঘরের বড় ছেলে। তাকে ঘরে এনেছে তুলেছে কয়েক বছর পার হয়েছে। প্রথম কবছর পেটে সন্তান আসেনি। এই নিয়ে স্বামীর মনে খানিকটা অসন্তুষ্টি যে ছিল না তা নয়। শেষমেষ দয়াল খোদা তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে।
রমিজার পেটে ভ্রুণ গজিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ছে অনাগত সন্তান। গত দুমাস ধরে এই সুখ বুকে নিয়ে দিন গুজরান করছে রমিজা। অথচ স্বামী এমন বুকের ধন পায়ে ঠেলে চেয়ারম্যানের লোকের প্ররোচনায় ঘর ছেড়েছে। এটা ভেবে তার বুক ভারী হয়ে ওঠে। চোখের কোণ বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ শরীরটা স্বামীর বুকের ওম খোঁজে।
তন্দ্রার ঘোরে সে হাত বাড়িয়ে স্বামীকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু শূন্য হাত শরীর কাঁপিয়ে বের হতে থাকা কান্নার দমক থামাতে মুখের ওপর ধীরে ধীরে চেপে বসে।