বিদ্যুৎ খাতের বড় এই প্রকল্পে নানা অনিয়মের কারণে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্পতি ছয় সদস্যের একটি চক্রের বিরুদ্ধে দেড় শ কোটি টাকা লোপাটের সন্ধান পেয়েছে সংস্থাটি।
জানা গেছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ১৪ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের ১৬টি কাজের ভেরিয়েশনের মধ্যে অনুমোদন ছাড়া ১১টি কাজের ভেরিয়েশন ছাড় দেওয়া হয়েছে।
অথচ এসব কাজের ভেরিয়েশন ছাড় দেওয়ার আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এ ছাড়া প্রকল্পের টাউনশিপ এলাকায় বালু ভরাট কাজে বোর্ডের অনুমতি ছাড়া ভেরিয়েশন প্রদান এবং ৬৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ, চুক্তি অনুযায়ী বিটুমিন বা পিচের সড়ক না করে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের নামে ২৫৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা নয়ছয়, নিলাম ছাড়া স্ক্র্যাপ বিক্রি করে ৫৩ কোটি টাকা লোপাট, ইনস্টিটিউশনাল ডেভেলপমেন্টের কনসালট্যান্ট নিয়োগের ৮.১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ, যন্ত্রপাতি ক্রয় চুক্তিতে উল্লেখিত দেশের পরিবর্তে ভিন্ন দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের পণ্য ক্রয় করে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে প্রকল্পের ঠিকাদারের লেফটওভার ম্যাটেরিয়াল বিক্রির মাধ্যমে চার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ পাওয়া যায়।
এছাড়াও প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন মূল্যবান মালপত্রের কান্ট্রি অব অরিজিন পরিবর্তন করে প্রকল্পে নিম্নমানের মালপত্র সরবরাহ করা হয়েছে।
সম্প্রতি মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অবৈধভাবে ১৫ কোটি টাকার তামার বৈদ্যুতিক তার পাচারের সময় জব্দ করে নৌবাহিনী। এ ঘটনায় পালিয়ে যাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) সাবেক এমডি আবুল কালাম আজাদসহ আটজনকে আটক করে।
আরও জানা গেছে, প্রকল্পটির জরুরি প্রয়োজনে ব্যয় করতে এক হাজার ৩৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
অনুমতি ছাড়াই এই বরাদ্দের পুরোটা ব্যয় করা হয়েছে। যে ১৫টি কাজের বিপরীতে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র চারটি কাজের অনুমতি দিয়েছিলেন সিপিজিসিএলের বোর্ড পরিচালকরা। বাকি ১১টি কাজে কোনো ধরনের অনুমতির তোয়াক্কা করেনি ছয় সদস্যের চক্রটি।
ছয় সদস্যের চক্রে রয়েছেন- সিপিজিসিবিএলের সাবেক এমডি আবুল কালাম আজাদ, নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ শহীদ উল্লা, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী (নকশা) মো. কামরুল ইসলাম, সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা আলফাজ উদ্দিন ও ডিজিএম (ডেপুটেশন) মতিউর রহমান। এই ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলমান।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুই ইউনিটের মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট। জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সহায়তায় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে এটি। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি তিন লাখ টাকা। বাকি টাকা সিপিজিসিবিএল তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে দিচ্ছে। দুই ইউনিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। দ্বিতীয় ইউনিট গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন করছে।
এ ব্যাপারে সিপিজিসিবিএলের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ শহীদ উল্লাকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে প্রকল্পটির দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি সিপিজিসিবিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. নাজমুল হক।
তিনি বলেন, ‘মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয় নিয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। ’ অভিযুক্ত অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করে তাঁদের পাওয়া যায়নি।
সিপিজিসিবিএলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগের এমডি আবুল কালাম আজাদ সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রকল্প থেকে বিভিন্নভাবে নানা সুবিধা প্রতিমন্ত্রীকেও দেওয়া হতো। ফলে বিভিন্ন সময় এমডির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও এ নিয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। ওপর মহলের লোকজনকে নানা সুবিধা দিয়ে তিনি একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে এসব অপকর্ম চালিয়ে গেছেন।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘প্রকল্প বিলাস’: মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ‘প্রকল্প বিলাস’ আখ্যা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎস্যন্দ্র প্রকল্পের বরাদ্দ ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৭ হাজার কোটি টাকা করেছে বিগত সরকার। অথচ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মাত্র এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি প্লান্ট করা হয়েছে। এই মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নকালে মেগাদুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্ত করা হবে। এরই মধ্যে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের এমডি আবুল কালাম আজাদকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব থেকে বাদ দিয়ে নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এই প্রকল্প থেকে সাধারণ মানুষ খুব বেশি উপকৃত হচ্ছে না। মূল প্রকল্পের ধারণা অনুসারে গভীর সমুদ্রবন্দর, শিল্প-কারখানা, রেল ও সড়ক সংযোগ না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিলাসী প্রকল্প থেকে সরকার সরে আসবে। ছোট প্রকল্পে মনোযোগী হবে, যাতে তা মানুষের কাজে আসে।
হাজার গুণ বেশি মূল্যে যন্ত্রপাতি ক্রয়: মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সাধারণ কিছু ‘হ্যান্ড টুলস’ আমদানিতেও বড় ধরনের অনিয়ম করা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছোট ছোট পাইপ কাটার, হাতুড়ি, মেটালসহ মোট ১৯টি সাধারণ যন্ত্রপাতি কিনতে হাজার গুণ পর্যন্ত বেশি মূল্য ধরা হয়েছে। একটি পাইপ কাটারের দাম ধরা হয়েছে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যার সাধারণ বাজারমূল্য সর্বসাকল্যে সাত হাজার টাকা। একটি হাতুড়ির দাম ধরা হয়েছে ৯১ হাজার টাকা, যেটির বাজারমূল্য ৮৩৪ টাকা। গত ৯ জানুয়ারি সিপিজিসিবিএলের অনুকূলে জার্মানি থেকে ৩৪৪.৫ কিলোগ্রাম ওজনের একটি চালান আসে। ওই চালানের আমদানিমূল্য মোট ২.৭৫ কোটি টাকা, যেখানে দুটি পাইপ কাটারের দাম দেখানো হয়েছে ৯২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ী সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। এতে খরচের মাত্রাও অনেক বেশি। এখানে জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি হয়েছে, অস্বাভাবিক দামে কেনা হয়েছে নাটবল্টু। এখন দেখা যাচ্ছে, এই প্রকল্পের পুরনো লোহালক্কড়ও বেচে দিচ্ছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। না হলে বিদ্যুৎ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না।