নিউজ ডেস্ক:আধুনিকতা, প্রযুক্তির ছোঁয়া, ঐতিহ্য বিমুখতা, গ্রামমুখী না হওয়া, শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হওয়া, কর্মমুখী ব্যস্ত জীবন পার করাসহ নানা কারণে বাঙলার পুরোনো ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। বলা যায়, অনেক কিছু এখন হারিয়েও গেছে। হারানোর এমন তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। বাঙালি জাতির অনেক ঐতিহ্যের স্মারক এখন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অনেকেই গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনেক কিছুই চেনে না, জানে না অনেক গ্রামীণ খেলাধুলা নামও।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে ভবন। ভবন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে খোলা স্থান, আঙিনা, মাঠ ও পরিত্যক্ত ভূমি। এটি অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলই বলা যায়। তাই এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে, যে হারে নগরায়ণ হচ্ছে, তাতে অন্তত আগামী দশক পর নগরে আর কোনো খেলার মাঠ অবশিষ্ট থাকবে কি না। প্রশ্ন আসছে, খেলার মাঠ ও খোলা আঙিনা আগামী প্রজন্মের কাছে কল্পনা হবে না তো? তদুপরি, খেলার মাঠগুলো বাণিজ্যিক মেলার ফাঁদে পড়ার কারণে সংকুচিত হয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশুদের মনন বিকাশের স্থান। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশু-কিশোরদের প্রারম্ভিক বয়সের উৎকর্ষ বিকাশ। অথচ শিশু-কিশোরদের জন্য প্রয়োজন মুক্ত আঙিনা। কারণ শিশুরা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যেই যথাযথ বিকাশ না হলে ভবিষ্যতে এর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
চুয়াডাঙ্গায় কয়টি খেলার মাঠ ছিল, এ নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও শহরে একসময় ছিল খেলার মতো পর্যাপ্ত মাঠ। তা ছাড়া, সে সময় শহরের জনসংখ্যাও কম থাকায় বাড়ির পাশে ছিল পর্যাপ্ত খোলা জায়গা। এসব খোলা জায়গায় দল বেঁধে শিশু-কিশোরা খেলত ইচিং-বিচিং, ওপেন টু বাইস্কোপ, কড়ি খেলা, কানামাছি, লাঠি খেলা, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, বউচি, টোপাভাতি, ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্ধা, পুতুল খেলা, ফুল টোকা, বাঘ-ছাগল খেলা, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, লাটিম, ষোল গুটি, এক্কাদোক্কা, এলাটিং-বেলাটিং, পানিঝুপ্পা, গোলাপ-টগর, রুমাল চুরি, ফুটবল, যুদ্ধ খেলা, ঘুড়ি ওড়ানোসহ হরেক রকম খেলা। কিন্তু এখন? এখন জাতীয় মানের দুটি স্টেডিয়াম এবং হাতে গোনা কয়েকটি বড় মাঠ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো মাঠই নেই শহরে। বর্তমানে শহরের ছোট-বড় মাঠগুলোর মধ্যে আছে চুয়াডাঙ্গা পৌর স্টেডিয়াম, চুয়াডাঙ্গা পৌর টাউন ফুটবল মাঠ, চাঁদমারি মাঠ ও জাফরপুর স্টেডিয়াম। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা পৌর স্টেডিয়াম ও জাফরপুর স্টেডিয়াম মাঠে জাতীয় ও জেলাভিত্তিক খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফলে এ দুটি মাঠ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। কিন্তু বাকি মাঠগুলো? এগুলোতে কি নগরের শিশু-কিশোররা খেলার পর্যাপ্ত সুযোগ পাই, এমন এক প্রশ্নের জবাবে এক শিশুসন্তানের অভিভাবক বলেন, ‘এসব খেলার মাঠ এখন মেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। বছরজুড়ে এসব মাঠে আয়োজন করা হয়ে থাকে বাণিজ্যমেলা, বস্ত্রমেলা, তাঁতমেলা, বৃক্ষমেলা, বিজয়মেলা, উন্নয়ন মেলা, বৈশাখী মেলা। একটি মেলা শেষ হলে মাঠ আবার ঘেরা হয় আরেকটি মেলার জন্য। ফলে খেলার মাঠে আমাদের সন্তানদের খেলাধুলার কোনো সুযোগই নেই।’
গতকাল বুধবার সোয়াদ বাবু নামের এক শিশুসন্তানের পিতা সুমন পারভেজ খান আক্ষেপের সুরে বলেন, এখন শহরে আর কোনো জমি ফাঁকা নেই। বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য ভরসা শুধু স্কুলের মাঠ। কিন্তু সেগুলোও ঠিকমতো দেখভাল করা হয় না। আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠই নেই। খেলার মাঠ কমে যাওয়ার নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে কম্পিউটার-মোবাইলে, খেলছে নানা ধরনের গেসমস।
শিশু-কিশোর ও তরুণেরা খেলাধুলা করার সুযোগ না পাওয়ায় ক্রমেই যুক্ত হচ্ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ। কমছে সুষ্ঠু ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের মানসিক বিকাশ। মাঠ না থাকায় তরুণ-কিশোররা দিনরাত ব্যস্ত থাকছে প্রযুক্তি পণ্যের ওপর। তাদের জন্য কম্পিউটার, মোবাইল ও ট্যাব পরিণত হয়ে উঠেছে অনেকটা খেলার মাঠে। পাবজি, ক্লাশ ওফ ক্লান, অনলাইন লুডোসহ নানা ধরনের গেইমসের প্রতি তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসব প্রযুক্তিপণ্যেই তারা বেশি সময় ব্যয় করছে। বিপথগামী হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এ কারণে শিশু কিশোররা অল্প বয়সেই শারীরিক নানা সমস্যায় পড়ছে। শরীরে বাসা বাধছে নতুন নতুন রোগ। কম বয়সী শিশুদেরও ব্যবহার করতে হচ্ছে চশমা।
এখন মাঠ না থাকায় শহরের বিভিন্ন এলাকার গলি-উপগলিতেই খেলতে দেখা যায় কিশোরদের। শহরের সচেতন নাগরিকের দাবি, ‘এখন সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে ভাবার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার, পরিকল্পিত নগর গড়ার এবং আগামী প্রজন্মের প্রয়োজনীয় বিকাশ নিশ্চিত করার। অন্যথায় নেতিবাচক পরিবেশেই বড় হতে হবে আমাদের সন্তাদের। চরম খেসারত দিতে হবে জাতিকে। শহর আমাদের। আমাদের উত্তর প্রজন্মকে এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে হবে। সব ক্লাব, ইনস্টিটিউট, স্কুল, মাদ্্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠ রাখা অত্যাবশ্যক করতে হবে। পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারকেই আগে পা বাড়াতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষেরও দায় আছে। দায়িত্ব নিতে হবে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদেরও।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন শিশুর অভিভাবক বলেন, ‘শহরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই। ছোট ছোট খেলার মাঠগুলো ভরাট করে তৈরি হচ্ছে বাড়ি, ক্লাব ও দোকানপাট। আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্বাভাবিক বেড়ে উঠতে পারছে না। পর্যাপ্ত মাঠের অভাবে আমাদের দেশে ভালো খেলোয়াড় জন্ম নিচ্ছে না। আবার শহরের হাতে গোনা যে দুটি খেলার মাঠ আছে, সেখানে উটকো যুবকদের আড্ডায়, ধুমপান, তাদের অশালীন আচরণে বাচ্চারা নিরাপদ নয়।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার বলেন, শিশু-কিশোরদের শারীরিক, মানসিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠের কোনো বিকল্প নেই। মূলত সুস্থ দেহেই থাকে সুন্দর মন। সুস্থ দেহ ও সুন্দর মনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিশু-কিশোরদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও পার্কের ব্যবস্থা করা। চুয়াডাঙ্গা শহরে সবার জন্য উন্মুক্ত মাঠ খুবই কম। অধিকাংশ শিশুর বাড়ির কাছে কোনো খেলার মাঠ নেই। উত্তর প্রজন্মকে এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে হবে।
চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য খেলার মাঠ, খেলাধুলার বিকল্প নেই। নগরায়ন ও ছোট ছোট ফাঁকা স্থানে নতুন নতুন বাড়ি তৈরির কারণে খেলার মাঠ যেমন কমছে, আবার দেখা যায় যেখানে খেলার মাঠ আছে সেখানে শিশু-কিশোররা খেলতে যায় না। কারণ, তাদের বাবা-মা মাঠে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার চাইতে ঘরের চার দেয়ালের সংকীর্ণতাকে সন্তানের জন্য অধিক নিরাপদ মনে করেন। মূলত মা-বাবার এ ধরনের মানসিকতা তাদের সন্তানের জন্য তৈরি করে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কারণ একজন বাচ্চা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে পারস্পারিক ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারত, তা তৈরি না হওয়ার দরুন প্রাধান্য দিচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থকে। মূলত প্রযুক্তির ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে রাখতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। সন্তানকে দিতে হবে সামাজিকীকরণের পরিবেশ। এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতটুকু করা সম্ভব পুলিশ প্রশাসন তা থেকে পিছুপা হবে না।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, বিজ্ঞান প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন স্মার্ট ফোনের যুগ চলছে, পৃথিবীটা চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। এখন প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে সময়ও কমেছে। আকাশ সংস্কৃতি ও স্মার্ট ফোন তাদের সময় কেড়ে নিয়েছে। এখন একদিকে খেলার মাঠ নেই, সময়ও নেই। অন্যদিকে খেলার ইচ্ছাও নেই। সব ইনস্টিটিউট, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠ রাখা অত্যাবশ্যক এবং প্রত্যেকের অভিভাবকদের তাঁদের সন্তানদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।