নিউজ ডেস্ক: দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এ বছরের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে।
বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে এবার বাংলাদেশের অবস্থান এসেছে ১৪৩ নম্বরে। গত বছর ১৪৫ নম্বরে ছিল বাংলাদেশের অবস্থান।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, দুই এক ধাপ করে উন্নতি কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয় এবং সেটাও খুবই ধীরগতিতে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের পাশাপাশি সমাজে অনেক ক্ষেত্রে নৈতিকতার অবক্ষয়ের কথাও বলছেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা বা আন্দোলন কি তাহলে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না, অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মই কী নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এসব প্রশ্নও এখন উঠছে।
বাংলাদেশে যে খাতগুলোকে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে ভূমি একটি। ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় ভূমি রেজিস্ট্রেশনের কার্যালয়ে গিয়ে অনেক মানুষের ভিড় দেখা গেল।
তারা জমি, বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন করতে এসেছেন। তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, ‘আমি জমি রেজিস্ট্রেশন করতে এসে ঘুরেছি কয়েকদিন। স্বাভাবিক নিয়মে আমার ফাইল বা কাগজপত্র নড়াচড়া করেনি।’
‘তারপর কিছু অর্থ দেয়ার পর আমার কাজ দ্রুত হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, জমি রেজিস্ট্রেশনে সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে বাড়তি অর্থ দিয়ে কাজ করানো একটা সিস্টেম হয়েছে।’
ভূমি কার্যালয়ে আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে তাদেরও একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। তারা যেন এটা একটা সিস্টেম হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
ভুক্তভোগী এই মানুষগুলোর অনেকের কাছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অগ্রগতির খবরকে আশ্চর্যজনক মনে হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপটারের ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুই এক ধাপ করে এই অগ্রগতিও ধীর গতিতে হচ্ছে। এজন্য তিনি সরকারগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকেই তিনি বড় বাধা হিসেবে দেখেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বে দুর্নীতির এই ধারণা সূচক প্রকাশ করছে ১৯৯৫ সাল থেকে। সংস্থাটি ২০০১ সালে বাংলাদেশকে তাদের গবেষণা প্রতিবেদনের আওতায় আনে।
সেই প্রথম দফাতেই দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে অবস্থান হয়েছিল বাংলাদেশের। পর পর পাঁচ বছর সেই শীর্ষ অবস্থানই বহাল ছিল।
২০০৬ সাল থেকে এক দুই ধাপ করে বাংলাদেশের অবস্থানের অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু সেটা সন্তুষ্টির নয় বলেই বলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সায়মা হক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করেন। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব এবং সামাজের অনেক ক্ষেত্রে নৈতিকতার অবক্ষয়কে বড় সমস্যা মনে করেন।
সায়মা হকের কথায়, ‘জবাবদিহিতার অভাবের কথা যদি বলি, একটা উদাহরণ দেই, প্রতি বছর বাজেটের আগে আমরা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কত টাকা খরচ হল বা হয়নি, এনিয়ে আমরা অনেক কথা বলে থাকি। কিন্তু এর আওতায় নেয়া প্রকল্পগুলোর পারফরমেন্স নিয়ে কথা বলি না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সচ্ছ্বতা আনা না গেলে দুর্নীতি কমবে না।’
তিনি আরও বলছেন, ‘সামাজিক মূল্যবোধ বা সামাজিক নৈতিকতা, এগুলোরও সমস্যা আমরা দেখছি।এবং একটা বাচ্চা ছোটবেলা থেকে পরিবার থেকে কী শিক্ষা পাচ্ছে? স্কুল থেকেই বা কী ধরনের শিক্ষা পাচ্ছে, সে বিষয়গুলোরই প্রভাব হয়তো আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।’
দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদও মানুষের সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়কে সামনে এনেছেন।
‘শুধু দুদক বা মিডিয়া বা দুয়েকটা স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে আসলে দুর্নীতি দমন বা কমানো সম্ভব নয়। সকলের জাতীয়ভাবেই একটা সম্মিলিত প্রয়াস নিতে হবে।’
দুদকের চেয়ারম্যান মি. মাহমুদ আরও বলেছেন, ‘আমরা যা বলি, আমরা তা বিশ্বাস করি কি না? আমরা যা বিশ্বাস করি, তা বলি কি না, এই যে সমাজে চারিদিকে এরকম একটা চিত্র!’
‘এই প্রশ্নে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, প্রাইমারি এবং হাইস্কুলের শিক্ষাটা যদি আমরা আর একটু পরিচ্ছন্ন বা কোয়ালিটিসম্পন্ন করতে পারি, তাহলে দুর্নীতি কমানো সম্ভব হবে। এটা আমি মনে করি।’
তবে সহসাই যে এসব প্রশ্নে পরিবর্তন সম্ভব, সেটা বিশ্লেষকরা মনে করেন না।
প্রতিবেদন : কাদির কল্লোল, বিবিসি বাংলা, ঢাকা