ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে বারো আউলিয়ার বারোবাজার। ঝিনাইদহ জেলা শহর থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে ঢাকা খুলনা মহাসড়কের পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত বারোবাজার। ১২ জন আউলিয়ার নামানুসারে এখানকার নামকরণ করা হয় বারোবাজার। আউলিয়ারা হলেন এনায়েত খাঁ, আবদাল খাঁ, দৌলত খাঁ, রহমত খাঁ, শমসের খাঁ, মুরাদ খাঁ, হৈবত খাঁ, নিয়ামত খাঁ, সৈয়দ খাঁ, বেলায়েত খাঁ ও শাহাদত খাঁ। এসব আউলিয়ার নামে শুধু বারোবাজার নয়, পার্শ্ববর্তী অনেক গ্রামগঞ্জের নাম আউলিয়াদের নামানুসারে রাখা হয়েছে।
কিংবদন্তি আছে, বঙ্গবিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি নদীয়া দখলের পর নদীয়ার দক্ষিণবাদক্ষিণ পূর্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে মনোযোগী না হয়ে উত্তর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে তার বিজিত রাজ্য উত্তর দিকে প্রশস্ত হতে থাকে। ওই অঞ্চলে বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন হজরত খানজাহান আলী। তিনি এক সময় নিজের আত্মরক্ষার্থে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতগঞ্জ প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বৃহত্তর যশোর জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার হাকিমপুর হয়ে বারোবাজার অভিমুখে রওনা দেন। পথিমধ্যে জনসাধারণের পানীয় জলের তীব্র কষ্ট দেখে তিনি এ অঞ্চলে অগণিত দিঘি আর পুকুর খনন করেন। এ অঞ্চলে ৮৪ একর পুকুর ও দিঘি এখনো বিদ্যমান।
জানা গেছে, পীরপুকুর ৪ একর, গোড়ার পুকুর ৫ একর, সওদাগর দিঘি ১১ একর, সানাইদার পুকুর ৩ একর, সাতপীরের পুকুর ৩ একর, ভাইবোনের দিঘি ৪ একর, আনন্দ ২ একর, গলাকাটা দিঘি ৪ একর, জোড়াবাংলা দিঘি ৩ একর, চোরাগদা দিঘি ৪ একর, মাতারানী দিঘি ৮ একর, নুনো গোলা দিঘি ৩ একর, কানাই দিঘি ৩ একর, পাঁচ পীরের দিঘি ৩ একর, মনোহর দিঘি ৩ একর, আদিনা দিঘি ৩ একর, শ্রীরাম রাজার দিঘি ১০ একর ও বেড় দিঘি ৮ একর। সর্বমোট ৮৪ একর দিঘি। খানজাহান আলীর এক যুগ সাধনার স্থাপত্য নিদর্শন রয়ে গেছে এই বারোবাজারে।
এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নিদর্শন ৩২ গম্বুজবিশিষ্ট সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ ও বারোবাজার গলাকাটা দিঘির ৬ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। যে মসজিদটি মাত্র দুটি ভিত্তির ওপর দন্ডায়মান রয়েছে। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে অগণিত মসজিদ। যে কোনো মাটির ঢিপি সরালেই মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়। যার অনেকগুলো ইতোমধ্যে আবিষ্কার করে আংশিক সংস্কারও করা হয়েছে। এখনো অনেক মসজিদ মাটির নিচে রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। কারণ এ পর্যন্ত যতগুলো মাটির ঢিপি সরানো হয়েছে ততগুলো মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
কিংবদন্তি আছে বহুকাল আগে এই বারোবাজার যুদ্ধে অথবা মহামারিতে জনশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর এখানে বারোজন আউলিয়ার আগমন ঘটে এবং তখন থেকেই তৈরি হয়েছে অগণিত মসজিদ, খনন হয়েছে পুকুর আর দিঘি। জলাশয়ের ঘটনাগুলো জনসাধারণ উপলব্ধি করলেও মসজিদগুলো মাটির ঢিপির নিচে থাকতে পারে বাংলাদেশ সরকারের খুলনা প্রতœতত্ত্ব দপ্তরের কর্মকর্তারা কয়েক বছর আগে এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে কিছু মসজিদ ও পাকা সিঁড়িগুলো আবিষ্কার করেছেন। এ ছাড়াও কয়েকটি মসজিদ সংস্কার করেছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠান্ড দৈনিক জানান, বারোবাজারের এই প্রতœতত্ত্ব নিদর্শনের তেমন প্রচার না থাকায় মূলত পর্যটকশূন্য। এ ছাড়াও আবাসিক হোটেল না থাকায় পর্যটকদের নজর কাড়তেও ব্যর্থ হচ্ছে ফলে বর্তমান প্রজন্মের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কেও জানতে পারছে না। সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে পর্যটকদের উৎসাহিত করলে এবং সরকারিভাবে মসজিদগুলোর শোভাবর্ধনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এটি আরো নান্দনিক ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।