স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহঃ
“কথায় আছে নামেই তালপুকুর কিন্তু ঘটি ডোবেনা”। বহুল প্রচারিত এই প্রবাদের মতোই যেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনেস্টিক সেন্টারগুলো। সুরম্য ভবন। তাতে এসি লাগানো। চোখ ধাঁধানো সাইনবোর্ডে লেখা অভিজ্ঞ সব চিকিৎসকদের নাম। কিন্তু কোথাও তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সদরের সাধুহাটী ও সাগান্না ইউনিয়নের ৬টি বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনেস্টিক সেন্টার পরিদর্শন করে চরম অব্যবস্থাপনা ও ঘাপলাবাজীর তথ্য মিলেছে। আদালতের নির্দেশে একজন পুলিশ কর্মকর্তার তদন্তে উঠে এসেছে ঝিনাইদহ স্বাস্থ্য বিভাগের বেহাল চিত্র। সাধুহাটী মোড়ের রাহেলা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন করে দেখা যায় সেখানে কোন চিকিৎসক নেই। নেই প্রশিক্ষিত নার্স। নার্সের কাজ করেন রত্না খাতুন ও লিমা পারভিন সুখি। তাদের নেই কোন অভিজ্ঞতা বা পড়ালেখার সনদ। হাসপাতালটির মালিক ডাঃ সোহরাব হোসেন অনুপস্থিত ছিলেন। হাসপাতালটির পরিবেশ স্বাস্থ্য সম্মত নয়। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোন লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। নবায়নের অপেক্ষায় থাকা হাসপাতালটিতে দোকান ঘরের মধ্যে বেড পেতে রোগী রাখা হয়েছে। আর এখানেই জটিল ও কঠিন অপারেশন করেন চুয়াডাঙ্গার চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডাঃ মশিউর রহমান ও অজ্ঞানের চিকিৎসক জিএম ডালিম। ঝিনাইদহের কোন চিকিৎসক সেখানে যান না বলে উল্লেখ করেন রাহেলা হাসপাতালের কথিত প্যাথলজিস্ট টুটুল আহম্মেদ। একই দশা ডাকবাংলা বাজারের আলজিজিয়া হাসপাতাল। সেখানেও সর্বক্ষনিক কোন চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। নেই প্রশিক্ষিক নার্স। এ্যপ্রোন পরে কাজ করছেন রেশমা ও মুসলিমা খাতুন নামে দুই যুবতী। তবে তাদের কোন সনদ নেই। চাহিদা মাফিক বেতন না দেওয়ায় এই ক্লিনিকে কোন নার্স থাকেন না। ক্লিনিকের মালিক আব্দুল মান্নানকে পাওয়া যায়নি। ডাকবাংলা নার্সিং হোমে গিয়ে দেখা যায় তদন্ত দলের আসার খবরে সবেমাত্র হাসপাতালে ধোয়া মোছার কাজ করা হয়েছে। ক্লিনিক মালিক আসাদুজ্জামান কাজল জানালেন তাদের সর্বশেষ নবায়ন ২০১২ সালে। সেখানে কোন চিকিৎসক নেই। নেই ডিপ্লোমাধারী নার্স। চম্পা ও রেখা নামে দুই নার্স অফিসে ছিলেন। ছটিুতে আছেন হিরা ও নাসিমা। তাদের কোন সনদ নেই। শফিকুল ইসলাম নামে একজন কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) কাজ করেন। ডাকবাংলা বাজারের আল আকসা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারটি তালাবদ্ধ ছিল। তদন্ত দলের যাওয়া দেখে খুলে দেন মধুহাটী গ্রামের আব্দুল জলিল। তার ছেলে ডাঃ ফাইনুল ইসলাম কুষ্টিয়ার কুমারখালী ডায়াবেটিক সমিতির জেনারেল ফিজিশিয়ান। আল আকসা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে প্রবেশ করে চক্ষু চড়ক গাছে উঠলো। সুরম্য ভবনে আল্ট্রাসনো ও ইসিজি রুমে বিছানা, বালিশ কাঁথা বিছানো। রুমের মধ্যে দিয়ে উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে। সাইনবোর্ডে কুষ্টিয়া সনো হাসপাতালের ডাঃ শামীমা সুলতানা, হরিণাকুন্ডু উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাঃ মোঃ জিল্লুর রহমান, ডাঃ উম্মে কুলসুম, শৈলকুপা ডায়াবেটিক সমিতির ডাঃ খালিদ সাইফুল্লাহ, যশোর মেডিকেল হাসপাতালের শাহিনুর আক্তার ও হরিণাকুন্ডু উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাঃ সাজেদুর রহমানের নাম থাকলেও স্থাপনায় বসার কোন চেম্বার নেই। ক্লিনিকটিতে উপস্থিত আব্দুল জলিল জানান, তিন মাসে আগে এটি প্রতিষ্ঠিত। সেখানে কোন রোগী দেখা হয় না। তবে ক্লিনিকটিতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলেও কোন প্যাথলজিস্ট পাওয়া যায় নি। ডাকবাংলা বাজারের ইসলামী (প্রাঃ) হাসপাতাল ও ডায়াগনেস্টিক সেন্টারেও কোন চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। নেই প্রশিক্ষিত নার্স। হাসপাতালের প্যাডে ডাঃ আব্দুল্লাহ, ডাঃ সাদ্দাম ও ডাক্তার পলাশের নাম লেখা আছে। কিন্তু পলাশ ও সাদ্দাম সেকমো হিসেবে ডিপ্লোা করা। তদন্ত দলের সামনে উপস্থিত নার্স পরিচয়দানকারী মিনা ও নাসরিনের কোন সনদ নেই। ইসলামী (প্রাঃ) হাসপাতাল ও ডায়াগনেস্টিক সেন্টারের আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট প্রস্তুত করাই আছে। বত্যায় ঘটলে রিপোর্ট হাতে লিখে দেওয়া হয়। ইসলামী (প্রাঃ) হাসপাতাল ও ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুন্সি শাহিন রেজা সাইদ জানান, তিনি সেবামূলক কাজের জন্যই ক্লিনিকটি চালু রেখেছেন। তার হাসপাতালের কোন লাইসেন্স নেই। নবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে বলেও জানান। সাগান্না ইউনিয়নের বৈডাঙ্গা প্রাইভেট হাসপাতালে কোন রোগী নেই। নেই সর্বক্ষনিক চিকিৎসক। রেক্সোনা খাতুন নামে এক মহিলা সেখানে নার্সের কাজ করেন। তার স্বামী থাকেন বিদেশে। সন্তান নিয়ে ওই ক্লিনিকের র্নাস ডিউটি রুমে বসবাস করেন। সেখানে রান্না ও রাত যাপনের ব্যবস্থা আছে। বৈডাঙ্গা হাসপাতালে কোন রোগী নেই। বেডগুলো ধুলোবালিতে ভরে গেছে। পরিবেশ মানসম্মত নয়। তারপরও ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকারী ফি জমা দিয়ে লাইসেন্স নবায়নের অপেক্ষায় আছেন পরিচালক ফারুক ও রানা। তাদের ভিজিটিং কার্ডে লেখা আছে “এখানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা রোগী দেখানো হয়। অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজড ডিজিটাল মেশিনের মাধ্যমে নির্ভুল ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়” তবে বাস্তবে সেখানে কোন চিকিৎসক তো নেই-ই, নেই কোন প্যাথলজিক্যাল সরঞ্জাম। অবাস্তব আর কল্পকাহিনীর ফাঁদে পড়ে হাসপাতালটিতে মানুষ অহরহ প্রতারিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে হাসপাতালটিতে বেশ কয়েকজন রোগীও মারা গেছেন। এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন ডাঃ সেলিনা বেগম জানান, আমি এসব ক্লিনিক ভিজিট করে বিস্মিত হয়েছি। কি ভাবে এসব ক্লিনিক বছরের পর বছর চলে আসছে সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন ক্লিনিকগুলোতে কোন মান নেই। চিকিৎসার কোন পরিবেশ নেই। সিভিল সার্জন ডাঃ সেলিনা বেগম বলেন, আমি মানহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনেস্টিক সেন্টার বন্ধের জন্য চিঠি পাঠিয়েছি। জেলা প্রশাসককেও চিঠি দিয়েছি। তিনি বলেন ১৫/২০ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে সময় লাগবে। তবে কেও ছাড় পাবে না বলে তিনি হুসিয়ার উচ্চারণ করেন। উল্লেখ্য বিভিন্ন পত্রিকায় গত ২১ আগষ্ট “ঝিনাইদহের ১৬৯ ক্লিনিক ও ল্যাব লাইসন্সে ছাড়াই চলছে” শিরোনামে তথ্য ভিত্তিক সংবাদ প্রকাশিত হলে ঝিনাইদহের একটি আদালতের দৃষ্টিগোচর হয়। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।