নিউজ ডেস্ক:
যে কারণেই হোক না কেন আমরা সবাই কখনো না কখনো মিথ্যে বলেছি। তাই বাচ্চা যখন মিথ্যে বলবে‚ প্রথমেই রিঅ্যাক্ট না করে নিজেও যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন সেটা ভেবে দেখুন। বাচ্চা মিথ্যা বললে তাহলে আপনি কী করবেন? বা বাচ্চা যাতে সত্যি বলে সেই অভ্যাসই বা করাবেন কী করে? আজ রইলো সেই বিষয়েই আলোচনা-
বাবা-মা যখন জানতে পারে তার সন্তান মিথ্যা বলছে তখন রাগ‚হতাশা‚ সন্তানকে অবিশ্বাস করা‚ কেন সে মিথ্যা বলছে তাই নিয়ে বিভ্রান্তি‚ বা বাচ্চাকে সঠিক ভাবে মানুষ করতে পারছেন না বলে নিজের ওপর অবিশ্বাস তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক।
আমরা সবাই জানি একমাত্র সৎ থাকলে এবং সত্যি বললেই সবার সাথেই সম্পর্ক ঠিক থাকে বা নতুন সম্পর্ক তৈরিও হয় এইভাবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও একই জিনিস হয়। আপনার সন্তান আপনাকে যতক্ষণ না বিশ্বাস করছে ততক্ষণ কিন্তু সে মিথ্যার আশ্রয় নেবে । তাই আগে নিজেকে তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলুন।
১) কেন মিথ্যা বলছে তা জানার চেষ্টা করুন :
ব্যাপারটার গভীরে গিয়ে দেখুন। সন্তান কেন মিথ্যা বলছে তা জানা কিন্তু খুব জরুরী। মনে রাখবেন শুধু শুধু কেউ মিথ্যা বলে না। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ থাকে। সেটা জানার চেষ্টা করুন। বাচ্চাকে বোঝার চেষ্টা করুন‚ মনোযোগ দিয়ে বাচ্চার কথা শুনুন। বাচ্চারা যেমন বড়দের ভাষায় কথা বলা শেখে তেমনি সব বাবা মায়েদেরও কিন্তু বাচ্চার ভাষা বুঝতে শিখতে হবে। মনে রাখবেন বাচ্চা কিন্তু যখন মিথ্যা বলে তখনো সে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছে। তার মিথ্যার মধ্যে কোনো লুকানো মেসেজ আছে কি না খতিয়ে দেখুন।
২) বাচ্চার বয়সের দিকে খেয়াল রাখুন :
বড়দের মতো বাচ্চারাও ডেভলপমেন্টের বিভিন্ন স্টেজের মধ্যে দিয়ে যায়। আমাদের যত বয়স বাড়ে আমাদের চিন্তাধারা বদলায় বা আমরা কল্পনা এবং রিয়েলিটির মধ্যে তফাত ধরতে পারি। বাচ্চার সঙ্গে য্খন ডিল করবেন তখন তার বয়স কতো তা সব সময় মাথায় রাখুন। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। একটা তিন বছরের বাচ্চা যদি বলে ‘ আমার দাদুর ২০০ বছর বয়স’। তখন কিন্তু সে মিথ্যা বলছে না, সে নিজে যেটা ভাবছে তাই বলছে। এবং সে কিন্তু তখনো জানে না ২০০ বছর মানে কত। বা ধরুন আপনার চার বছরের মেয়ে আপনাকে একদিন বললো পার্কে খেলতে গিয়ে তার একটা পরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে তখন সে কিন্তু রিয়েলিটি আর তার কল্পনার মাঝামাঝি জগতে আছে। তাই এই অবস্থায় সেও কিন্তু মিথ্যা বলছে না। অন্যদিকে আপনার ৮ বছরের পুত্র হোমওয়ার্ক না করে টিভি দেখেছে এবং আপনি যখন তাকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করছেন সে কিন্তু বারবার বলছে সে টিভি দেখেনি‚ তখন কিন্তু সে জানে আসলে কী হয়েছে এবং সে কী বলছে তার মধ্যে পার্থক্য আছে। তাই বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে মিশতে হবে।
৩) বাচ্চার এক্সপ্রেশনের দিকে নজর দিন :
অনেক সময় আপনার সন্তান বুঝতে পারে না সে কী বলছে। যেমন ধরুণ আপনি তাকে প্রশ্ন করলেন ‘ তুমি কেমন আছো? বা আজকের দিনটা তোমার কেমন গেলো ? উত্তরে সে হয়তো বললো ‘ আমি ঠিক আছি ‘ বা ‘ ঠিক আছে’ বাচ্চার জীবনে যদি কোন সমস্যা এসেও থাকে সে কিন্তু তা বুঝতে পারে না। তার জীবনে যে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে সে হয়তো তা জানেই না। তাই উত্তরে ‘সব ঠিক আছে’ বলা মানেই কিন্তু সে মিথ্যা বলছে না। আবার এও হতে পারে সে হয়তো ঠিকমত নিজেকে এক্সপ্রেস করতে পারছে না। তাই শুধুমাত্র সন্তান কী বলছে তাতে গুরুত্ব না দিয়ে তার এক্সপ্রেসন লক্ষ্য করুন। যেমন ধরুন স্কুলে হয়তো কারুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে আপনার সন্তানের। মুখে সে বললো সব ঠিক আছে কিন্তু দেখলেন সে চুপচাপ ঘরের এক কোণে বসে আছে‚ বা অন্যদিন সে যেখানে বন্ধুকে নিয়ে প্রচুর কথা বলে সেদিন বন্ধুর প্রসঙ্গ উঠলে তা এড়িয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আপনি একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন গণ্ডগোলটা কোথায়।
৪) বাচ্চার সঙ্গে কমিউনিকেশন যেন আপনার ফার্স্ট প্রায়োরিটি হয় :
মনে রাখবেন বাচ্চার সঙ্গে আপনি নিজে যত কানেকটেড থাকবেন তত বেশি আপনাদের মধ্যে বিশ্বাস্যোগ্যতা স্থাপন হবে। এবং বাচ্চাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে না। বাচ্চার সঙ্গে যথাযথ সময় কাটালে সে তার জীবনের সব কথা আপনাকে জানাবে এমনকি সে কী ভাবছে তাও জানাবে। তাই বাচ্চার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করাটা ভীষণ জরুরী এবং মিথ্যা বলার সব থেকে বড় প্রিভেন্টিভ মেজারও বলতে পারেন।
৫) নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনুন :
মনে রাখবেন আপনার বাচ্চা কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রে আপনাকে নকল করার চেষ্টা করে। তাই আপনি যা করবেন সেও তাই শিখবে। এছাড়াও কোনদিন এমন প্রতিশ্রুতি বাচ্চাকে দেবেন না যা আপনি রাখতে পারবেন না। কারণ সে ভাববে‚ হয়তো কিছু প্রমিস করলে তা রাখার কোনো দরকার নেই‚ ঠিক আপনি যেমন তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেই কাজটা করেন নি তেমন।
৬) ৬-৭ বছরের বাচ্চাদের নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে :
যেমন ধরুণ সে কারুর সঙ্গে মারামারি করলো বা কাউকে ইচ্ছা করে মিস গাইড করলো তখন তাকে শেখান সে যা করেছে তার ফল ও কিন্তু তাকেই ভোগ করতে হবে। যেমন সে হয়তো তার কাছের বন্ধুকে মিথ্য বলেছে তখন তাকে বোঝান ভবিষ্যতে তার বন্ধু কিন্তু তাকে বিশ্বাস করবে না। যদি দেখেন আপনার বাচ্চা আপনার সঙ্গে মিথ্যা বলছে তাহলে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন। এবং সে যে ভুল কাজ করছে তাকে বোঝান। বা কী করে সে আবার বিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে তাও শেখান।
৭) বাচ্চা যেন আপনাকে বিশ্বাস করে সব বলতে পারে সেরকম পরিস্থিতি তৈরি করুন :
আপনার বাচ্চা যদি বুঝতে পারে সে যা বলছে আপনি বিশ্বাস করছেন না‚ বা তার কথায় আপনি দুঃখ পাচ্ছেন বা তার কথা শুনে আপনার উদ্বিগ্ন‚ বা তাকে বিচার করছেন বা তার কথায় উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন সে তাহলে কিন্তু আর আপনার সঙ্গে খোলাখুলি মিশবে না। এই পরিস্থিতি যাতে না তৈরি হয় তার জন্য সর্বপ্রথম নিজেকে বিচার করে দেখুন‚ আপনি একজায়গায় আটকে যান নি তো? যেমন ধরুণ কিছু টপিক আছে যেমন সেক্স‚ ধর্ম‚ এইসব টপিক নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই না। কিন্তু বাচ্চা এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যাবেন না। যতটা পারবেন সহজ ভাষায় তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন। যেমন ধরুণ আপনার টিনএজার বাচ্চা আপনাকে সেক্স সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করলো তার উত্তরে তাকে বকাঝকা না করে বা ভুল তথ্য না দিয়ে যতটা সঠিক ভাবে সম্ভব বুঝিয়ে দিন। মনে রাখবেন বাচ্চার সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশার চেষ্টা করুন।
৮) বাচ্চাকে সত্যি কথা বলার গুরুত্ব বোঝান :
সে মিথ্যা না বলে কেন সত্যি বলবে সেটা কিন্তু আপনাকেই শেখাতে হবে। একই সঙ্গে শেখান সত্যি বলা মোটেই কঠিন কাজ নয়। একই সঙ্গে এও শেখান যে একটা মিথ্যা কথা ঢাকতে তাকে আরো অনেক মিথ্যার সাহায্য নিতে হবে। সত্যি বললে সে কী পাবে তাও বোঝানোর চেষ্টা করুন।
৯) বাচ্চাকে বোঝান যে আপনিও ভুল করতে পারেন :
আপনি যা বলেন বা যা করেন সেটা যে সব সময় ঠিক হবে তার কোনো মানে নেই‚ বাচ্চাকে বোঝান আপনারও ভুল হতে পারে। তাকে বোঝান সে যেমন আপনার ওপর নির্ভরশীল আপনিও তেমনি তার ওপর নির্ভর করেন। তাকে বোঝান যে তাকে যেমন তার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয় তেমনি তার কাছে আপনাকেও সেই বিশ্বাযোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছে। নিজেদের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাস গড়ে তুলুন। আপনি কোনো ভুল করলে অবশ্যই তার জন্য ক্ষমা চান।
১০) বাচ্চাকে কোনদিন মিথ্যাবাদী বলে লেবেল করে দেবেন না :
তাকে মিথ্যবাদী প্রতিপন্ন না করে সে কেন মিথ্যা বলছে তা জানার চেষ্টা করুন। তাকে মিথ্যাবদী বলে লেবেল করে দিলে সে লজ্জা পাবে এবং সেই লজ্জা ঢাকতে বারবার মিথ্যা বলবে। সে যেটা করেছে তার জন্য আপনি যে দুঃখ পেয়েছেন তাকে বোঝান বা তার থেকে আপনি কী আশা করেছেন তাও বোঝানোর চেষ্টা করুন। কিন্তু একই সঙ্গে সন্তানকে বোঝান যে সে আসলে একজন ভালো মানুষ এবং তার যে সত্যি কথা বলার সাহস আছে তাও বুঝিয়ে দিন। এর ফলে আপনার বাচ্চা নিজে শোধরানোর মোটিভেশন পাবে। এবং এও প্রমাণ হয়ে যাবে অপনি তাকে বিশ্বাস করেন‚ ভরসা করেন। আপনার বাচ্চা নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে অপরাধী ভাববে কিন্তু তা ঠিক আছে। বাচ্চা যদি মিথ্যা বলার জন্য অনুতপ্ত হয় তাহলে তা ভালো লক্ষণ। কিন্তু একই সঙ্গে তাকে এও বোঝান সে মিথ্যা বলেছে বলেই অপদার্থ নয়।