নিউজ ডেস্ক:
চুয়াডাঙ্গায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের নাম তালিকা প্রকাশ করাকে কেন্দ্র করে সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ মানুষের মুখে মুখে। ২৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় আক্রান্ত ৬ জনের পরিচয়, মোবাইল নম্বরসহ তালিকা ও মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) অমীমাংসিতভাবে থাকা ২৮ জন আক্রান্ত রোগীর নাম পরিচয়সহ তালিকা ফেসবুকের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা, অন্যদিকে নাম তালিকা প্রকাশ না করার শর্ত থাকা সত্ত্বেও তা প্রকাশ করায় দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তাদের ওপরে উঠছে আঙুল। আস্থা হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এরকম একটি স্পর্শকাতর বিষয় কীভাবে ছড়াল। স্বাস্থ্যবিভাগ বা অন্য যেসব দপ্তরে এ তথ্য যায়, তাঁদেরকে আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। সেই সাথে এই জন্য সস্মুখে কীভাবে প্রকাশ হলো, তাঁর তদন্তের মাধ্যমে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সচেতন মানুষেরা।
চুয়াডাঙ্গায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আবেগ এবং উৎকণ্ঠাও বাড়ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ার সাথে সাথে কুসংস্কারের কারণে তৈরি হচ্ছে নানা প্রকার সামাজিক সমস্যা। মানুষের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর কুসংস্কারে অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের নাম পরিচয়।
জানা গেছে, গত ২৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৬ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়। শনাক্ত হওয়ার পরপরই আক্রান্ত ৬ জন ব্যক্তির নাম পরিচয়, মোবাইল নম্বরসহ ঠিকানা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। আইইডিসিআরের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এই নাম পরিচয় ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের একটি প্যাডে এটি প্রকাশ পায়। আর এই প্যাডে চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনের স্বাক্ষরও দেখা যায়। এ ঘটনার পর অসচেতন মানুষের ফেসবুকে যেমন পাতাটির ছবি ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তেমনি সচেতন মানুষের ওয়ালে দেখা যায় সমালোচনার ঝড়। নানা মানুষ নানা প্রকার মন্তব্য এবং প্রশ্ন তোলেন এ কা-জ্ঞানহীন কাজে। চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগের সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতার ওপর প্রশ্ন তোলেন সচেতন মানুষেরা।
অন্যদিকে, এ ঘটনা ঘটার পর ২৮ এপ্রিল হঠাৎ কিছু সাধারণ মানুষের ফেসবুক ওয়ালে দেখা যায় আরেকটি তালিকার। এই তালিকায় আলমডাঙ্গা উপজেলার ১৯ জনের নাম ঠিকানা দেখা যায়। উপরে লেখা ‘করোনা পজিটিভ ব্যক্তিদের তালিকা আলমডাঙ্গা থানা, চুয়াডাঙ্গা। যদিও এতে তেমন কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি, তবে যেহেতু চুয়াডাঙ্গায় ততক্ষণে আক্রান্ত আছে কি না, তার আনুষ্ঠানিক ব্রিফ আসেনি। তাই এ তালিকা নিয়েও নানা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান প্রথমে কিছু না জানালেও পরে তিনি নিশ্চিত করেন চুয়াডাঙ্গায় ২৮ জন করোনাভাইরাস পজেটিভ। পরীক্ষা করা হয়েছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে। এত বেশি পরিমাণে আক্রান্তের খবরে জনমনে সৃষ্টি হয় নানা আতঙ্কের। খবর নিয়ে জানা যায়, আক্রান্তদের বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। তখন গণমাধ্যমকর্মীরা ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো তালিকার সাথে লকডাউন করা বাড়িগুলো মিলিয়ে দেখে তালিকাটি সঠিক।
অপর দিকে, গণমাধ্যমকর্মীসহ সচেতন মানুষের মধ্যে তখন প্রশ্ন ওঠে প্রকাশিত তালিকাটির উৎস কোথায়। আনুষ্ঠানিক ব্রিফ হওয়ার আগেই এরকম একটি গোপনীয় এবং স্পর্শকাতর বিষয় কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল? এ ধোঁয়াসার সমাধান হওয়ার আগেই চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ আরএকটি মেইলে চুয়াডাঙ্গায় ২৮ জনের করোনা পজেটিভ অমীমাংসিত ঘোষণা করেছেন।
এ রকম একটি আশ্চর্য্যকর ঘটনার বিষয়ে গতকালই চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শামীম কবির জানান, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিসিআর ল্যাবে মূলত তিনটি জেলার (চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া) করোনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। গত সোমবার থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু প্রথম দিনেই তিনটি জেলার আক্রান্তের হার বেশি হওয়ায় রিপোর্টগুলো পুন:পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ঢাকাতে আইইডিসিআর কার্যালয়ে পাঠানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আইডিসিআর থেকে রিপোর্ট আসার পরই পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্যবিভাগের একের পর এক সিদ্ধান্ত এবং কা-জ্ঞানহীন কাজের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় ধু¤্রজালের। একদিকে যেমন স্বাস্থ্য বিভাগের সচেতনতার কথা, অন্যদিকে তেমনি পজেটিভ না আসা সত্ত্বেও নাম ঠিকানা প্রকাশ পাওয়ার ঘটনায় স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর থেকে আস্থা হারাবার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে।
এদিকে, বিবিসি বাংলার করা করোনাভাইরাসে আক্রান্তের নাম পরিচয় প্রকাশ করা ঠিক কিনা এমন এক জরিপে একজন লিখেছেন, বাংলার জনগণ অতিউৎসাহী, এরা দেখা যাবে ঠিকানা পেলে বাড়ি ঘর জ্বালাবে, নয়তো আত্মীয়-স্বজনকে মারবে, কাজের কাজ কিছুই করবে না সুতরাং ঠিকানা প্রকাশ করার কোন প্রয়োজন নেই। আলমের মতো অনেকেই মনে করেন পরিচয় প্রকাশ করলে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের অন্য সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক আঘাত করবে আশপাশের মানুষজন।
আর প্রথম থেকেই আইইডিসিআর এর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। পরিচয় প্রকাশ পেলে তাঁরা সামাজিকভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে পারে। সংস্থাটির পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, রোগীর পরিচয় প্রকাশ করা চিকিৎসা বিজ্ঞানের নৈতিকতাবিরোধী। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো দেশই রোগীর পরিচয় প্রকাশ করছে না। তারা পরিচয় প্রকাশ করছেন না কেন সে সম্পর্কে আরও ব্যাখ্যা দিয়ে মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘এখানে রোগীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি চলে আসে। বাংলাদেশে মানুষজন অনেক সময় সংবেদনশীল আচরণ করে না।’ এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্তদের তার সম্পর্ক তথ্য বের হল তারা স্টিগমাটাইজড হতে পারে। এই জন্য আমরা কারো সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছি না।
সরকারিভাবে প্রত্যেকটি জেলা ও উপজেলার স্বাস্থ্য বিভাগকে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এ রকম অবস্থায় চুয়াডাঙ্গায় স্বাস্থ্য বিভাগের কা-জ্ঞানহীন কাজের কারণে সচেতন মানুষে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন। সমালোচনার ঝড় বইছে সর্বত্রজুড়ে।
সিভিল সার্জনের স্বাক্ষরিত করোনাভাইরাসে পজেটিভ রোগীদের নামের তালিকা দেখার পর মাছরাঙা টিভির জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক ফাইজার চৌধুরী তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্ট দিয়ে লেখেন, ‘দুর্যোগের এক মাসে চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন সবচেয়ে কা-জ্ঞানহীন কাজটি করেছেন আজ। মোবাইল নম্বরসহ আক্রান্তদের নাম পরিচয় প্রকাশ করে।’
যমুনা টিভির জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম ডালিম বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে সরকারিভাবে একটি নির্দেশনা আছে। তাঁদের নাম পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু চুয়াডাঙ্গার প্রেক্ষাপটে নাম-পরিচয়সহ আক্রান্ত ব্যক্তিদের তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বেশ কয়েক জায়গায় প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ বা অন্য যার মাধ্যমেই হোক এই তথ্য প্রকাশ পাওয়া ঠিক হয়নি। বিষয়টির সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন।
প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক শাহ আলম সনি বলেন, যেই বা যারা এই কাজটি করেছে সেটি সঠিক হয়নি। সামজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে পরিত্যাগ করার একটা প্রবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই বিষয়ে স্পষ্ট করে সরকারি নির্দেশনা আছে কোনোভাবেই তাঁদের নাম তালিকা প্রকাশ করা যাবে না। আক্রান্তদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির নাম পরিচয় প্রকাশ করা অন্যায়। যদি এটা ছড়িয়ে থাকে, তবে তা মোটেও উচিত হয়নি। কোনোভাবেই এই তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। সাংবাদিকদেরও তথ্য দেওয়ার সময় নাম পরিচয় গোপন রেখে অন্য তথ্য দিতে হবে। যদি স্বাস্থ্যবিভাগ বা অন্য কোনোভাবে এটি ছড়ায় তাহলে সেটি অন্যায়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ছড়াতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার এখান থেকে এটি ছড়াবে না, সেটির আমি নিশ্চিত। আমার এখানে সব তথ্য সঠিকভাবে গোপন রেখেই কাজ হয়। সরসারি নির্দেশনা মোতাবেকই সবকিছু করা হয়। এমন ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে আর না হয় বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা খুবই গোপনিয় একটা বিষয়। ছড়ানো উচিত হয়নি। ভবিষ্যতে যাতে না ছড়ায় সে বিষয়ে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেব।
চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্তের নাম পরিচয় প্রকাশ পাওয়া উচিত নয়। তালিকাটি বেশ কয়েকটি স্থানে পাঠানো হয়। আমার এখান থেকে বা অন্য কোনো স্থান থেকেও ছড়ানোর সম্ভবনা আছে। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে ও সদর হাসপাতালে সাধারণ মানুষেরা প্রবেশ করতে পারে। এখন কীভাবে এটি ছড়িয়েছে, সেটি আমার জানা নেই। তবে আমি গোপন রেখেই সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করেছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখা হবে। আর দ্বিতীয় দিন কুষ্টিয়ার রিপোর্টটির তালিকা আমার কাছে ছিল না। সুতরাং সেটি কীভাবে ছড়িয়েছে, সেটি আমার জানা নেই।’