ব্যক্তিগত জীবনের, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের, এমনকি কর্মক্ষেত্রের নানা ঘটনায় মান-অভিমানে ভারী হয় মানুষের মন। কখনো কখনো এই মান-অভিমান সম্পর্কের ছেদ টেনে দেয়। ফলে অতি আপনজনের সঙ্গেও বন্ধ হয়ে যায় কথাবার্তা, যোগাযোগ ও মুখ দেখাদেখিও। ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দিলেও কিন্তু তা যখন সম্পর্কচ্ছেদের প্রশ্ন হয়ে ওঠে তাকে প্রশ্রয় দিতে বারণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের অধিক সময় সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে থাকবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৭৬)
আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক:
হাদিসবিশারদরা বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানের সঙ্গে কথা বন্ধ করার ব্যাপারে তিন দিনের অবকাশ দিয়েছেন যেন মানুষ তার রাগ, ক্ষোভ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়। হাদিসের শিক্ষা হলো, মানুষের আবেগকে মূল্যায়ন করতে হবে। তবে তা যদি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সংকট তৈরি করে তবে তা বর্জন করতে হবে। বিশেষত যখন আবেগ সৃষ্টির পেছনে কোনো নৈতিক ভিত্তি ও শরয়ি কারণ না থাকে।
অভিমান যেন বিদ্বেষে পরিণত না হয়:
মান-অভিমান থেকে যে দূরত্ব তৈরি তা যেন পরস্পরের মনে বিদ্বেষ তৈরি করতে না পারে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর দরবারে বান্দার আমল পেশ করা হয়। আল্লাহ সব মুসলিমকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু যে ব্যক্তির সঙ্গে তার ভাইয়ের মধ্যে বিদ্বেষ ছিল। তাদেরকে ছেড়ে দাও যতক্ষণ না তারা মিলিত হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৫)
হাসিমুখই ইসলামের কাম্য:
মান-অভিমান আড়াল করে হাসিমুখে কথা বলাই ইসলামের নির্দেশনা। রাসুলুল্লাহ (সা.) হাসিমুখে কথা বলাকে সদকা আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘প্রতিটি ভালো কাজই সদকাস্বরূপ। তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সহাস্য দেখা-সাক্ষাত্ করা এবং তোমার বালতির পানি দিয়ে তোমার ভাইয়ের পাত্র ভর্তি করে দেওয়াও ভালো কাজের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৭০)
সম্পর্কচ্ছেদ কোনো কোনো মানুষের জন্য মৃত্যুতুল্য। প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদ কখনো কখনো মানুষকে অস্বাভাবিক জীবন, এমনকি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এজন্য দীর্ঘ বিচ্ছেদের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেন, ‘যে তার ভাইয়ের সঙ্গে এক বছর সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখল সে যেন তাকে হত্যা করল।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯১৫)
যে অভিমান ভাঙ্গে সেই উত্তম:
মানবিক আবেগের কারণে পরস্পরের প্রতি অভিমান সৃষ্টি হতে পারে। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সেই উত্তম যে অভিমান ভাঙ্গতে এগিয়ে আসে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির জন্য বৈধ নয় যে সে তার ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের বেশি এমনভাবে সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে যে, দুজনের দেখা হলেও দুজন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে। তাদের মধ্যে যে আগে সালাম দেবে সেই উত্তম ব্যক্তি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৭৭)
দ্বিনের প্রশ্নে কথা বন্ধ রাখা বৈধ:
আল্লামা ইবনুল আরাবি মালেকি (রহ.) বলেন, ‘দ্বিনের ব্যাপারে কাউকে সতর্ক করতে অথবা অন্যদেরকে পাপী ব্যক্তির পাপ সম্পর্কে সতর্ক করতে যদি তার সঙ্গে কথা বন্ধ রাখা হয়, তবে তা বৈধ। যেমন কেউ কোনো পাপ কাজ করল অথবা বিদআতে লিপ্ত হলো। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) তাবুক যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে পড়া তিন সাহাবির সঙ্গে ৫০ দিন কথা বন্ধ রাখার অনুমতি দেন। অতঃপর আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করেন এবং সাহাবিরা তাদের সঙ্গে আগের মতোই সদ্ব্যবহার করেন।’ (আরিদাতুল আহওয়াজি : ৮/৯১)
আল্লাহ সবার জীবনকে সুন্দর করে দিন। আমিন।