এমনিতেই টানা ক্লাসের চাপে দম ফেলার উপায় নেই। সামনে পরীক্ষাও আছে।
প্রায় দিনই প্র্যাকটিক্যালের খাতা ভরার যন্ত্রণা তো আছেই। ফলে ক্লাসে যখন স্যার এসে বললেন, স্টাডি ট্যুরে যাব, শুনেই তো লাফিয়ে উঠলাম। আমরা হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদে পড়ি। লেভেল ফাইভ, সেমিস্টার একের ছাত্রছাত্রীর সবাই। এক ভোরে একে একে ক্যাম্পাসে চলে এলাম। তাকিয়ে দেখি, সকাল ৯টায়ও যে বন্ধুকে ঠেলে ক্লাসে পাঠানো যায় না, সে-ও এসে হাজির! এরপর দুই বাস চলল নাটোরের পথে। পথের কুয়াশা যেন বরণ করে নিল। গাড়িতে শখের গায়ক, নৃত্যশল্পীরা প্রতিভা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। ক্লাসের মতো বাসেও বেলালের কথা, কৌতুকের তোড়ে ভেসে গেলাম। লাবু, মিঠুন, রিমন, সালাউদ্দিন, বারী, মামুন, নাজমুল, সোহেল, মুনির, শুভ, আসিক, রবিউল, পরমা, পিউ, ফাইজা, রিংকি ও রমা কখনো গান, কখনো গল্প, কখনো কৌতুকে হাসিয়ে মারল। কেউ গাইল—‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম দেখা পাইলাম না’, কেউ ‘ওরে নীল দরিয়া’।দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে সকালের নাশতা করলাম। স্যারদের সঙ্গে ছবি তোলা হলো। আমাদের সঙ্গে ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফখরুজ্জামান ও প্রভাষক ড. আতিকুল হক আছেন। দিনাজপুর পেরিয়ে গাইবান্ধা ঘুরে চলে এলাম বগুড়া। নাটোর-পাবনা মহাসড়ক দিয়ে গাড়ি ছুটছে। তাকিয়ে দেখি, পানিতে দুলছে ধান। অদ্ভুত সেই দৃশ্যে চোখ জুড়ালো। আরে, এই তো সেই চলনবিল! বর্ষকালে পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে উঁচু উঁচু করে বানানো বাড়িঘর, স্কুল। সব যেন দোতলা থেকে শুরু হয়েছে। নৌকাই এদের বাহন। রাজশাহী বিভাগের—রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ—এই চার জেলার আটটি উপজেলা, ৬০টি ইউনিয়নের এক হাজার ৬০০ গ্রামের মানুষের স্বাদু পানির মাছের প্রধান উত্স চলনবিল। করতোয়া, আত্রাই, বড়াল, মরা বড়াল, চিকনাইয়ের মতো ১৪টি নদীতে এক হাজার ৪২৪ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত বিশাল বিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কোথাও ছোট নৌকায় দুই-তিনজন জেলে মাছ ধরছেন, পাট বোঝাই নৌকা গন্তব্যে ছুটছে দেখলাম।
এরপর নাটোরের গুরুদাসপুরে এসে প্রাণ ডেইরি হাবে (দুগ্ধ সংগ্রহশালা ও শীতলাগার) পৌঁছলাম। এটিই আমাদের গন্তব্য, হাইজেনিক দুগ্ধ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানব। এটি দুগ্ধজাত খাবার ও দুগ্ধ সংগ্রাহক প্রতিষ্ঠান প্রাণের দুধ সংগ্রহকেন্দ্র। বাস থেকে ৭০ জন ছেলেমেয়ে নেমে পড়লাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়ভাই মিজানুর রহমান হাবের ম্যানেজার। তিনি সব ঘুরিয়ে দেখালেন। হাবে ২২টি দুধ সংগ্রহকেন্দ্র আছে। প্রতিদিন সকালে আশপাশের খামারিরা তাঁদের দুধ এনে কেন্দ্রগুলোতে জমা দেন। আলাদা পরীক্ষাগারে সেগুলোর চর্বি ও ভেজাল পরীক্ষা করা হয়। যেসব খামারির দুধ পরীক্ষায় ফেল করে, সেগুলো ফেরত যায়। তারপর দুধ শীতল করে প্রতিষ্ঠানের নারায়ণগঞ্জের কারখানায় দুগ্ধজাতীয় পণ্য তৈরির জন্য পাঠানো হয়। মিজান ভাই জানালেন, প্রতিদিন তাঁরা ২০ থেকে ২৫ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করেন। আমরাও এত দিন ল্যাবরেটরিতে শেখা বিষয়গুলো হাতে-কলমে কিভাবে কাজ করে তা শিখে নিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলে উত্তরা গণভবন দেখতে গেলাম। নাটোর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে ‘দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি’। এটিই এখন ‘উত্তরা গণভবন’। চারপাশে উঁচু দেয়ালে ঘেরা রাজবাড়ি এলাকার মোট জায়গার পরিমাণ চার হাজার ১৫১ একর। ভেতরে লেক, ১২টি ছোট-বড় কারুকার্যমণ্ডিত রাজপ্রাসাদ ও হাজারো ফুল-ফলের বাগান আছে। কর্মকর্তারা আমাদের এর ইতিহাস শোনালেন—নাটোরের রানি ভবানী নায়েব দয়ারামের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘দিঘাপতিয়া পরগনা’ দান করেন। সর্বশেষ রাজা প্রতিভানাথ রায় ১৯৫২ সালে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। ১৯৭২ সালে একে সরকারীকরণ করা হয়। এভাবে সারা দিনের ভ্রমণ শেষে সবাই ক্যাম্পাসে ফিরে চললাম।