তানভির সোহেল, আলমডাঙ্গা:
আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ গ্রামে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বোরো ধান বীজ উৎপাদন প্রদর্শনী প্লটে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। ধানখেতে ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কৃষকের পুড়েছে স্বপ্ন। কৃষি বিভাগের পরামর্শে বালাইনাশক প্রয়োগ করেও কোনো প্রকার প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও হাল না ছেড়ে দিনভর কৃষকেরা ব্যস্ত থাকছেন ফসলি খেত রক্ষার কাজে। কৃষকদের দাবি, সরকারিভাবে বীজ প্রদান করলেও ধানের খেতে আসেননি কোনো কৃষি কর্মকর্তা। ফোনেই ধানের রোগের বিষয়ে ওষুধ প্রয়োগের নির্দেশনা প্রদান করেন তাঁরা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে আলমডাঙ্গা উপজেলায় ১৩ হাজার ৪৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধানচাষ হয়েছে। যার প্রায় ৭০ শতাংশই হয়েছে উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে। গত বছরের তুলনায় এ বছর বোরো ধানে ফলন ভালো হলেও নাগদাহ গ্রামে বেশ কয়েকজন কৃষকের মাথায় হাত। গত বছরের শেষের দিকে সারা দেশের ন্যায় আলমডাঙ্গায় বোরো ধান রোপণ করা হয়। আলমডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিটি ইউনিয়নের বিভিন্ন ধান, ভুট্টা, গমসহ বিভিন্ন ফসলের প্রদর্শনী প্লট করা হয়। ওই সব বীজ রোপণ প্লটে চাষের জন্য সরকারিভাবে আলমডাঙ্গা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের মাধ্যমে বীজ প্রদান করা হয়। এরই মধ্যে আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ ইউনিয়নের স্কুলমাঠে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্লট নির্বাচন করা হয়। বোরো ধানবীজ উৎপাদন প্রদর্শনী প্লটে জামাত আলীর ছেলে সুজন আলী, দুখিয়া মণ্ডলের ছেলে লিটন মণ্ডল, গফুর মণ্ডলের ছেলে তারিক মণ্ডল, শুকুর আলীর ছেলে আশকার আলী, ইসলাম জোয়ার্দ্দারের ছেলে গোলাম জোয়ার্দ্দার, মুনছুর দাইয়ের ছেলে রসুল দাই, গফুর মণ্ডলের ছেলে আবু তালেবের জমি নির্বাচন করে।
এ বছর ১৫ বিঘা জমির ধানের প্লটে ব্রি-ধান-৮১ রোপণ করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রদর্শনী প্লটের বিল বোর্ড ও নির্মাণ করা হয় ধানের খেতে। কৃষি অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের ধানের বৈশিষ্টগতভাবে জানানো হয় ব্রিধান-৮১ ধান লম্বা ও চিকন। এ ধান ফলনে ১ হেক্টর জমিতে ৬ থেকে ৬ দশমিক ৫ টন ধান উৎপাদন হবে। হিসাবে হেক্টর প্রতি ১৫০ মণ ও বিঘা প্রতি ৫০ মণ ধান উৎপাদন হবে। ৫ হেক্টর জমিতে এখন ৫ মণ ধারণ হবে কি না, সন্দেহ প্রকাশ করেন ভুক্তভোগী কৃষকেরা।
নাগদাহ ইউনিয়নের বোরো চাষি আবু তালেব, গফুর মণ্ডল, আশকার আলী ও ইসলাম জোয়ার্দ্দার জানান, ধানগাছে ফুল আসা মুহূর্তে ধানে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। ধানের শীষগুলো আস্তে আস্তে সাদা হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। শীষের গোড়ায় প্রথমে এ রোগ দেখা দিচ্ছে। পরে আস্তে আস্তে পুরো শীষকে গ্রাস করছে। শীষের ধানগুলো চিটা হয়ে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগ পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু স্প্রে করে কোনো কাজ হচ্ছে না। বিশেষ করে ব্রিধান-৮১ জাতের এ ধানে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠকর্মী রুপা খাতুনকে জানানো হলেও তিনি ফোনের মাধ্যমে পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি কখনো ধানের খেতে আসেননি। তাঁরা আরও জানান, ‘এ রোগের আক্রমণে উৎপাদন কমে গেছে। কোনো কোনো খেতের ধান সব চিটা হয়ে গেছে। ধানের ফলন না পেলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমাদের মারাত্মক বিপাকে পড়তে হবে।’
হতদরিদ্র কৃষক আশকার আলী বলেন, ‘আমার ৩ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছি। এখন পুরো ধানখেতে এমন রোগে ধরছে, সন্ধ্যায় রেখে যাই এক রকম, আর সকালে এসে দেখি আরেক রকম। দিন দিন সব ধানের শীষ শুকিয়ে যাচ্ছে। এক দিকে স্যালোমেশিনের খরচ, অন্যদিকে মহাজনের টাকা। কোনটা কীভাবে দেব, ভেবে পাচ্ছি না। বাড়িতে ছাগল, মুরগি যা ছিল, সব বিক্রি করে আবাদ করেছি। এখন তো ধানের সঙ্গে আশা-ভরসা সব জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কোনো ওষুধ দিয়েও তো কাজ হচ্ছে না। এখন আমি কী খাব, আর জমির মালিককে কী দেব?’
এ ব্যাপারে নাগদাহ ইউনিয়নে নিয়োজিত মাঠকর্মী রূপা খাতুন বলেন, ‘আমরা সঠিকভাবে বীজ দিয়ে তাঁদের চাষের উপযোগী করে দিয়েছি। কৃষক আশকার তাঁর জমিতে অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহারের কারণে এ ভাইরাস ধানখেতে ছড়িয়েছে। আমরা তালিকা করে পাঠিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিবেন কৃষকদের কী সহযোগিতা করা যায়।’
আলমডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান, ব্লাস্ট ছত্রাকজনিত ও বীজবাহিত রোগ। আকাশ মেঘলা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলে বা গরম-ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়ও এ রোগের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। সংশ্লিষ্টরা কৃষকের ফসল রক্ষার্থে তাঁদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘মাঠকর্মীরা আমাকে বলেছেন, ১৫ থেকে ২০ শতক জমিতে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিষয়ে আউশ ধানে বীজসহ বিভিন্ন উপাদান প্রদান করা হবে।’