দর্শনা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি নাগরিক আকন্দবাড়িয়ার
নিউজ ডেস্ক:দর্শনার নিমতলা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত বাংলাদেশি নাগরিক নাজিম উদ্দীনের (৩৪) লাশ ফেরত দিয়েছে বিএসএফ। গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে দর্শনা আন্তর্জাতিক জয়নগর চেকপোস্টের জিরো পয়েন্টে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠকের পর নিহত নাজিমের লাশ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ।
পতাকা বৈঠকের সময় বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিল খালিশপুর-৫৮ বিজিবির ধোপাখালী বিওপি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার রেজাউল করিম, জীবননগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফেরদৌস ওয়াহিদসহ ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল। আর ভারতের পক্ষে উপস্থিত ছিল গেদে বিএসএফ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসি সৌরভ সামন্তসহ ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল।
গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ৫৮ বিজিবির সহকারী পরিচালক নজরুল ইসলাম খান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ ও লাশ ফেরত চেয়ে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিএসএফের কাছে পত্র প্রেরণ করা হয়। এরপর বিএসএফ নিহতের লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে।
জীবননগর থানার পরিদর্শক (ওসি) তদন্ত ফেরদৌস ওয়াহিদ জানান, বিজিবির কাছে নিহত নাজিমের লাশ হস্তান্তরের পর পুলিশের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে রাতেই ওই লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, নিহত নাজিমের লাশ পরিবারের লোকজন গতকাল শুক্রবার রাত ১০টার দিকে পুলিশের কাছ থেকে গ্রহণ করে নিজ গ্রাম আকন্দবাড়িয়া গাঙপাড়ায় নিয়ে এলে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ নাজিমের লাশ দেখতে ছুটে আসেন। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে আকন্দবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জানাজা শেষে মাঝপাড়া কবরস্থানে নাজিমের লাশের দাফনকার্য সম্পন্ন করা হয়।
কে এই নাজিম
সমীকরণ প্রতিবেদন:
চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের আকন্দবাড়িয়া গ্রামের গাঙপাড়ার তরু মিয়ার ছেলে নাজিম। নাজিমের পিতা হিসেবে তরু মিয়ার নাম এলেও তাঁর আসল পিতার নাম আবুল কালাম। নাজিমের মা শোভার প্রথম বিয়ে হয় জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়ীয়া কাশিপুর গ্রামের আবুল কালামের সঙ্গে। নাজিমের জন্মের কয়েক বছর পর তাঁর মা শোভাকে তালাক দেন কালাম। পরে শোভা ২য় বিয়ে করেন আকন্দবাড়িয়ার তরু মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের পর তরু মিয়া ও শোভার সংসারে সুজন, সুমন, রতন ও রনি নামের চার ছেলে ও চাঁদনী নামের একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। জানা গেছে, সৎভাই-বোন হলেও আপনের মতো করে তাঁদের দেখাশোনা করতেন নাজিম।
যেভাবে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লেন নাজিম:
ছোটবেলা থেকে অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা নাজিম প্রাথমিক শিক্ষার গ-ি পার হতে পারেননি। একদিকে পিতা থেকেও নেই, আর অন্যদিকে মায়ের অবহেলা। নাবালক থেকে সাবালোকের কোঠায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভারতীয় চিনি-লবনের ব্যবসা করে টাকা উপার্জন শুরু করেন। সেই থেকে কাঁচা টাকার প্রতি লোভ তাঁকে অন্য কোনো ভালো পথে উপার্জন করতে দেয়নি। পরে মা শোভার সঙ্গে শুরু করেন মাদকের ব্যবসা।
স্থানীয় লোকজন জানান, নাজিম ছোটবেলা থেকে শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর মাদক ব্যবসা বিস্তার না ঘটলেও তাঁকে পুঁজি করে মা শোভা ব্যাপক পরিসরে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। ১০ বছর আগে নাজিম প্রতাপপুর গ্রামের রফিকুলের মেয়ে রুলিখা খাতুনকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর পাঁচ বছর তিনি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরে তিনি ওই ব্যবসা থেকে অনেকটাই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে নাজিমের সংসারে জন্মগ্রহণ করে আবু হুরাইয়া নামের একটি পুত্রসন্তান। আবু হুরাইয়ার বয়স এখন তিন বছর। বছর খানেক আগে নাজিম গরুর ব্যবসা শুরু করেন। দিনের বেলায় বিভিন্ন সীমান্ত-সংলগ্ন হাট থেকে গরু কিনে হাটে-হাটে গরু ব্যাপারীদের সঙ্গে গরু বিক্রি করতেও দেখা গেছে নাজিমকে। তবে দিনের বেলায় গরু ব্যবসা করলেও সচ্ছল জীবনযাপন করতে মাঝেমধ্যেই তিনি রাতে মায়ের মাদক ব্যবসার জন্য মাদক আনতে যেতেন। সীমান্ত থেকে মাদক এনে দিলে মা শোভা তার জন্য নাজিমকে খরচ দিতেন। স্থানীয় এক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, যে দিন রাতে নাজিম সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হন, সে দিন রাতেও তিনি তাঁর মায়ের ব্যবসার মাদক আনতে গিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার রাতে নাজিম উদ্দীনসহ সাত-আটজন গরু ব্যবসায়ী দর্শনার নিমতলা সীমান্তে গেলে ভারতের গেদে বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে নাজিম উদ্দীন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে বিএসএফের সদস্যরা তাঁর লাশ টেনেহিঁচড়ে ভারতের অভ্যন্তরে নিয়ে যান। এরপর বিএসএফ নিহতের লাশ কৃষ্ণনগর থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ওই দিনই কৃষ্ণনগর হাসপাতালে তাঁর লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।