মো:ফরিদ উদ্দিন,লামা (বান্দরবান) থেকে: বিদ্যালয়ে যেতে সাঁতার কেটে নদী পার হতে গিয়ে নদীর ¯্রােতে ভেসে যায় ৮ বছরের ম্যাসি অং ও সাড়ে সাত বছরের মং ক্যাচিং মারমা। এ সময় সাথে থাকা অন্য শিশুরা আত্মচিৎকার শুরু করে। পরে স্থানীয়রা এসে প্রায় ২শত গজ দূর থেকে উদ্ধার করে তুলে আনে তাদের। এতে এবারের মতো বেঁচে যায় ওই দুই শিশু। শুধু এটাই নয়! এরকম ঘটনা প্রায় ঘটছে বান্দরবানের লামা উপজেলার লামা সদর ইউনিয়নের এম. হোসেন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন নদীতে। তাই দূর্ঘটনা এড়াতে প্রতি বর্ষা মৌসুমে প্রায় চার মাস শিশু শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠান না অভিভাবকরা। সাঁতার জানা চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই এসময়ে বিদ্যালয়ে আসে। ক্ষীনকন্ঠে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ জিয়াবুল হক শিক্ষার্থীদের কষ্টকর জীবেনর চিত্র এই প্রতিবেদকের নিকট তুলে ধরেছেন।
প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ জিয়াবুল হক বলেন, শুষ্ক মৌসুমেও বিদ্যালয় সংলগ্ন এই নদীতে ৫/৬ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়। ওই সময়েও এই ছোট ছোট শিশুরা সাঁতার কেঁটে বিদ্যালয়ে আসে। নদী পার হতে গিয়ে কাপড়- চোপড় ভিজে যায়। ওই ভেজা কাপড় নিয়েই ক্লাস করে। শিশুদের বলেছি, দুইটা কাপড় নিয়ে আসতে। যাতে নদীর পার হওয়ার পর ভিজা কাপড়টি পাল্টে আরেকটি পড়তে পারে। কেউ কেউ নিয়ে আসে। বাকীরা ভেজা কাপড় নিয়েই ক্লাস। প্রায় সময় শিক্ষার্থীরা এসে কাঁদে। বলে স্যার আমার বই পানিতে ভেসে গেছে। তখন পুরোনো বই দিয়ে তাদের তাদের বুঝ দিতে হয়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, লামা সদর ও রূপসীপাড়া ইউনিয়নের ঠিক মধ্যবর্তী স্থানেই এম. হোসেন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর এই বিদ্যালয় সয়লগ্ন নদীর ওপাড়েই অংহ্লাডুরী মারমা পাড়া, ছিচাখইন মারমা পাড়া, কলার ঝিরির মুখ, লক্ষণ ঝিরি, তাউ পাড়া, নয়া পাড়া ও এম. হোসেন পাড়া। এসব পাড়ার শিশুরাই এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। সাঁতার কেঁটেই নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে এসব শিক্ষার্থীরা।
অংহ্লাডুরী মারমা পাড়ার বাসিন্দ মংএথোয়াই মারমা এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। আলাপকালে তিনি এই এই প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে নিজেদের অসহায়ত্তের কথা প্রকাশ করে বলেন, এই নদী আমাদের অনেক সন্তান ভাসিয়ে নিয়েগেছে। প্রতিদিনই কোন না কোন অভিভাককে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলে-মেয়েদের নদীর পাড় করিয়ে দিয়ে আসতে হয়। কারণ জীবনের ঝুকি নিয়েই শিশুরা বিদ্যালয়ে যায়। যারা মোটামুটি সাঁতার জানে, তাদেরকে বিদ্যালয়ে পাঠাই। আর যারা জানে না তাদেরকে পাঠাই না। বলেন, মংএথোয়াই।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো: রবিউল আলম বলেন, শুষ্ক মৌসুমেও এই নদীতে পানির ¯্রােত থাকে। আর বর্ষা মৌসুমে রাক্ষুসে হয়ে উঠে। বর্ষা মৌসুমে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি থাকে খুব কম। তিনি বলেন, স্কুলের শিক্ষার্থীরা গায়ের জামা খুলে সাঁতার কেটে নদী পাড় হয়েই বিদ্যালয়ে আসে। শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকির বিষটি বিবেচনা করে এই নদীর উপর এশটি ব্রীজ নির্মাণের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে আবেদন করেছি।
লামা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন জানায়, বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের কষ্টের চিত্র তুলে ধরে ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিসয়ক প্রতিমন্ত্রীর নিকট আবেদন করেছি ওই স্থানে একটি ব্রীজ চেয়ে। হতাশার সুরে চেয়ারম্যান বলেন, এখনো বরাদ্দ মিলেনি।
লামা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার যতীন্দ্র মোহন মন্ডল বলেন, ওই বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকির বিষয়টি অনেকবার উপজেলা শিক্ষা মিটিংয়ে বলেছি। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বেড়ে গেলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আর আসে না, শিক্ষকরা অনেক সময় যায়না।
লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খিনওয়ান নু বলেন, উপজেলার প্রায় দূর্ঘম এলাকার বিদ্যালয়গুলোর চিত্র এমনই। অনেক কষ্ট করে জীবনের ঝুকি নিয়েই পিছিয়েপড়া উপজাতি ও বাঙালী ছেলে মেয়েরা পড়ালেকার জন্য কষ্ট করে যাচ্ছে। আশা করি এবিদ্যালয়ের শিক্ষাথীর্িদের সমস্যা সমাধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন।