চুয়াডাঙ্গার সন্তান কেবিন ক্রু শাহিদুজ্জামান সাগর
নিউজ ডেস্ক:বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজটির (বিজি-১৪৭ ফ্লাইট) ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গত রোববার বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে ছেড়ে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরই উড়োজাহাজটি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। প্রায় দুই ঘণ্টার টান টান উত্তেজনার পর উড়োজাহাজ ছিনতাই চেষ্টার অবসান ঘটে। বেঁচে যায় ১৪৭ জন যাত্রী। যার বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতা ছিনতাই চেষ্টা ব্যর্থ হয়, সেই কেবিন ক্রু শাহিদুজ্জামান সাগর চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাদিমপুর ইউনিয়নের বটিয়াপাড়া গ্রামের কৃতি সন্তান।
সেদিন জীবন বাজি রেখেছিলেন কেবিন ক্রু শাহিদুজ্জামান সাগর। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে বিমান ছিনতাইকারী পলাশকে নানা কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখেছিলেন। শেষে তাকেই জিম্মি করে রেখেছিল মারমুখী পলাশ। সেনা কমান্ডোদের চোখকে ফাঁকি দিতে কেবিন ক্রু সাগরের পোশাক খুলে নিজেই পরে নিয়েছিলেন ছিনতাই চেষ্টাকারি পলাশ। কিন্তু সাগর কৌশলে উড়োজাহাজ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে না এলে হয়তো তার ভয়ঙ্কর কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। উড়োজাহাজের যাত্রী ও তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানান।
সূত্র জানায়, প্রথমেই ছিনতাইকারী পলাশ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েছিল বিমানের সব কেবিন ক্রুদের। এরমধ্যে কৌশলে কেবিন ক্রু সাগর বিষয়টি পাইলটকে জানান। পাইলট তখন চট্টগ্রামে জরুরি অবতরণ করেন। এ সময় আকাশে উড়ে চলা উড়োজাহাজের মধ্যে পলাশকে সামাল দেওয়ার জন্য তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে নানা ধরনের গল্প করতে থাকেন কেবিন ক্রু শাহিদুজ্জামান সাগর অন্যন্যরা। কিন্তু মারমুখী পলাশকে সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছিল কেবিন ক্রু সাগরদের।
বিমানের একজন যাত্রী বলেন, ছিনতাইকারীর হাতে অস্ত্র ছিল। একটা শব্দও তিনি পেয়েছেন। ধোঁয়ার কুন্ডলি দেখা যায় বিমানের ভিতর। এতে আতঙ্ক দেখা দেয় সবার মধ্যে। এ সময় ক্রু সাগর যেন ত্রাণকর্তার মতো কাজ করতে শুরু করেন। যাত্রীদের জীবন রক্ষায় নিজের জীবন বাজি রেখে ছিনতাইকারীকে ব্যতিব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন। তাকে চা-কফি খাইয়ে, সমস্যার সমাধান করার অজুহাতে ছিনতাইকারির সময় ক্ষেপণ করায়। বিমান ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের রানওয়েতে। তখন যাত্রী সাধারণ জরুরি পথে নামতে শুরু করে। পাইলটও নেমে যান। শুধু ভিতরে আটকে থাকেন সেই চুয়াডাঙ্গার সাহসি সন্তান বিমান কেবিন ক্রু সাগর। তাকে জিম্মি করে ফেলে ছিনতাইকারি পলাশ। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি তখন তিনি। কেউ নেই উড়োজাহাজে। শুধু ছিনতাইকারী পলাশ এবং সাগর। সহকর্মি সাগরের খোঁজ নিতে ভিতরে আবারও ঢুকেছিলেন আরেক কেবিন ক্রু সাকুর। কিন্তু সাগর তাকে চলে যেতে বলেন। উড়োজাহাজ তখন ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাগরের ফোনেই বাইরে থেকে সব যোগাযোগ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছিনতাইকারী পলাশ এ সময় বুঝতে পারেন ভিতরে অভিযান হয়তো হবে। তখন তিনি বাঁচতে শেষ চেষ্টা করেন। আর তার চেষ্টার ঘুঁটি হিসেবে রাখেন সাগরকে। তিনি সাগরের পোশাক খুলে দিতে বলে। সাগর তখন তাই করে। পলাশ কেবিন ক্রুর পোশাক পরে নিজেকে সেনা কমান্ডোর টার্গেট থেকে আড়াল করতে চেয়েছিল। এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল সাগর নিজেও। তিনি হয়তো টার্গেটে পড়ে যাবেন। সাগর তার পোশাক খুলে পলাশের হাতে তুলে দেন। পলাশ সেই পোশাক নিয়ে যখন পরতে শুরু করেন, ঠিক ওই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দৌড়ে উড়োজাহাজ থেকে বেরিয়ে যান কেবিন ক্রু সাগর। নতুন জীবন ফিরে পান সাগর। তাঁর বুদ্ধিমত্তায় যেমন উড়োজাহাজ রক্ষা পায়, তেমনি জীবন বাঁচে ১৪৭ জন যাত্রীর। কমান্ডো অভিযানও সফল হয়।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাদিমপুর ইউনিয়নের বটিয়াপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামান দেশ স্বাধীন করতে ১৯৭১ সালে যেমন জীবন বাজি রেখেছিলেন, ঠিক তেমনি তার সন্তান বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রু শাহিদুজ্জামান সাগর ২০১৯ সালে নিজের জীবন বাজি রেখে বাচাঁলেন বিমানের ১৪৭ জন যাত্রী জীবন।
কেবিন ক্রু শাহিদুজ্জামান সাগর বটিয়াপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামানের ছেলে ও জাতীয় শ্রমিক লীগ, চুয়াডাঙ্গা জেলার শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ওজোপাডিকো’র শ্রমিক নেতা নজরুল ইসলাম কেতুর জামাই।