জাতকুল ভুলে পবিত্র বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা দু’জনে
মোঃ ফরিদ উদ্দীন, লামা (বান্দরবান) প্রতিনিধি : বান্দরবানের লামা উপজেলার এক হিন্দু যুবককে ভালবেসে বিয়ে করে অনিশ্চিত জীবনের মুখমুখি ঢাকার মেয়ে মনিকা। উম্মে খাদিজা জামান (মনিকা) পিতা মো: রফিকুজ্জামান সালাম, মাতা-রওশন আরা বেগম, গ্রাম কুড়ারগাঁও, পোষ্ট- মির্জানগর-১৩৪৪, সাভার ঢাকা।
সাইক্লোজি বিভাগে ডিগ্রীপাশ করা মনিকা বিগত ক’বছর আগে বাবা মা’র সাথে কক্সবাজার বেড়াতে আসে। সেখানে পরিচয় হয় মিশু দাসের সাথে। পরিচয় থেকে প্রেম, পরস্পর ভালো বন্ধু; মাস খানেক একসাথে থাকা, অতপর জাতকুল ভুলে পবিত্র বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা দু’জনে।
মিশু দাস, পিতা স্বপন কুমার দাস, মাতা বিজলী রাণী দাস, সাং চামাপাতলী ২নং ওয়ার্ড, লামা পৌরসভা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা। মিশু দাসের বাবা স্বপন কুমার লামা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা। তিনি বর্তমানে এলপিআর-এ আছেন।
মনিকা আর মিশুর পরিচয়প্রেম, বন্ধুত্বর প্রায় মাস খানেক পর মনিকা জানতে পারে মিশু হিন্দু ধর্মাবলম্বি। মিশু ভালো করেই জানতেন মনিকা মুসলমান মেয়ে। বৈবাহিক বন্ধন ছাড়াই তারা দুজন রাঙ্গামাটিতে বাসাভাড়া নিয়ে থাকেন। সমাজ সভ্যতার দায়বোধ থেকে এক পর্যায়ে মিশুর বড় ভাই বিশ্বজিত তাদেরকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। তাদের উভয়ের সিদ্ধান্তমতে গত ১৪ মে/২০১৫ চট্টগ্রাম জজ কোর্টের এডভোকেট মোহাম্মদ মিয়া রহিমের মাধ্যমে নোটারী পাবলিক হলফনামা মুলে বিয়ে হয়। ৮ জুলাই/২০১৫ তারিখে রাঙ্গামাটি তবলছড়ি উপজেলায় নিকাহ রেজিষ্টার কার্যালয়ে এক লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করে নিকাহনামা রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন হয়।
এ বিয়েতে বর-কণের দু’পরিবারই নারাজ ছিলেন। মিশুর বড় ভাই বিশ্বজিত নোটারী পাবলিক করার সময় উপস্থিত ছিলেন। সে জানায়, তারা দু’জনই প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিক বিয়ে বা ধর্মান্তরের সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে। এ নিয়ে পরবর্তীতে কোন ধরণের ঝামেলায় যেন দু’জনের পরবিারের কেউ জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়টি নোটারী পাবলিক হলফ নামার ৪ নং কলামে উল্লেখ রয়েছে। তা ছাড়াও বিশ্বজিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে চট্টগ্রাম কোর্টে একটি জিডি করে রেখেছেন।
দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও পুরুষ ধর্মান্তর হওয়ার বিধান রয়েছে। সে মতে মিশু ও কনিকা যে কোন কেউ ধর্মান্তরিত হওয়ার ব্যাপারটি উভয়ের মধ্যে আলোচনাক্রমে করে নেয়ার কথা ছিল। অব শেষে মিশু নিজ থেকে ইসলাম ধর্মের প্রতি পূর্নাঙ্গ আস্থা এনে গত ৬ জুলাই/২০১৫ তারিখে চট্টগ্রাম জজ কোর্টের এডভোকেট মোহাম্মদ মিয়া রহিমের মাধ্যমে নোটারী পাবলিক হলফনামা মুলে ধর্মান্তরিত হয়ে মো: আরাফাত রহমান মিশু নাম করণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন।
অতিসম্প্রতি তারা চট্টগ্রাম জোয়ারাগঞ্জ-এ বাসা ভাড়া করেন। গত ৯ অক্টোবর সকাল ৭টায় মনিকার স্বামী মিশু অফিসিয়াল কাজে কক্সবাজার যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে যায়। এর পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ। ওইদিন মিশুর মোবাইল থেকে মনিকার ছোট ভাইয়ের মোবাইলে একটি ম্যাসেজ যায়; তাতে লেখা রয়েছে ‘তোমরা তোমাদের বোনকে নিয়ে যাও আমিও চলে গেলাম’। মনিকা তার স্বামীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করে কোন হদিস না পেয়ে তার ছোট ভায়ের সাথে যোগাযোগ হলে এ ম্যাসেজের কথা জানতে পারে বলে জানান।
মনিকা স্বামীর কোন খোঁজ না পেয়ে অবশেষে ১০ অক্টোবর চট্টগ্রাম জোরারগঞ্জ থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করে-নং ৪০৮। পরদিন বুধবার মিশুর বাবা মায়ের বাড়িতে লামায় এসে হাজির হন। মিশুর পরিবার মনিকাকে ঘরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। মনিকা এখন মিশুর বাবা মায়ের বাড়ির দরজায় বসে আছে; হয়তো মিশুর সন্ধান দিতে পারবে তাঁর বাবা মা; এমন প্রত্যাশায়।
বিয়ের আগ থেকে মিশু পর্যটন হোটেল-মোটেলে চাকুরী করে বেশ টাকা আয় করতেন। প্রতিদিন অনেক টাকা হাত খরছ হতো তাঁর। বিয়ের পর রাঙ্গামটিতে বাসা নিয়ে থাকতো এবং একটি বে-সরকারি সোলার প্যানেল কোম্পানিতে ২৬ হাজার টাকা মাইনে চাকুরী করতেন। মিশুর স্ত্রী মনিকা জানায় তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রায় তিন বছরে কখনো কোন ধরণের মনমালিন্য হয়নি। গত কয়েক মাস ধরে মিশু আর্থিক সংকটে ভোগেন, এতে তার মন খারাপ থাকতো। মনিকা জানায়, মিশুর আর্থিক সংকট নিরশনে আমি আমার বাবা মায়ের সহযোগিতা চেয়ে, তাদের অবাধ্যতার কারেণ পাইনি। আমার বাবা মাও আমাদের সম্পর্কটি মেনে নেন নাই। অপর দিকে মিশুর পরিবার থেকেও মেনে নেননি।
১১ অক্টোবর বেলা ১১টায় মনিকা লামা প্রেসক্লাবে এসে সাংবাদিকদের এসব তথ্য দেন। সে জানায়, মিশুর আর্থিক সংকটের সুযোগকে পূঁজি করে তার বাবা মা তাকে লুকিয়ে রেখেছে। কয়েকদিন আগ থেকে মিশুর পিতা-মাতা শিশুকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে ভারতে পাটিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। মিশু এসব ব্যাপারে আমার ও তার অফিসিয়াল কলিকদের সাথে শেয়ার করতো, আমাদের দু’জনের মধ্যে বিশ্বাস ও ভালো বাসার কোন ঘাটতি ছিল না নেই। এসব কথা বলে খদিজা জামান মনিকা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মনিকা জানান, মিশু প্রায়ই সময় বলতো তার পরবিার তাকে অনেক টাকা দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলছে। এতে মিশু শংকিত ছিল যে, তাকে ভারতে পাটিয়ে হয়তো ঘুম করে ফেলা হতে পারে। মিশু সব সময় সব বিষয়ে মনিকাকে শেয়ার করতো।
প্রেম মানেনা জাতকুল, জন্ম-জন্মান্তর নর-নারীর প্রেম। স্বর্গ থেকে প্রেম এসেছে পৃথিবীতে। এই প্রেম শাশ্বত নিয়মেই চলছে। মানুষে মানুষে বৈরিতা যেমন সৃষ্টি করে এই প্রেম, তেমনি সমাজ-পরিবারে অনেক দ্বৈরথের নিরশণও করে চলছে। কেবল ধর্ম-বর্ণভেদ প্রেমের পবিত্র বন্ধন ছিন্ন করতে পারেনি সভ্যতার সূচনা থেকে এই পর্যন্ত। সূতরাং মনিকা-মিশুর প্রেমেও বিরহ বেদনা যেমনি দেখা দিয়েছে, তেমনি এই যুগলের মেলবন্ধনও হবে ঠিক সময়ে।
জানাগেছে, মিশুর বাবার ভাই একজন ভারতে থাকে। মিশুকেও তার বাবা মা সেখানে পাটিয়ে দিতে পারে, এমন সন্দেহ করছেন মনিকা। এদিকে মিশুর পরিবার থেকে বলা হয়েছে; মিশু ঠিক কোথায় আছে এ তথ্য তাদেরও জানা নেই।
মিশুর ভাই যিশু দাস জানান, তাদের সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ নেই। মিশুর আর্থিক সংকটে আমাদের পরিবার সব সময় পাশে থেকেছে। বিভিন্ন সময়ে আমার মা আমি তার জন্য বিকাশে টাকা পাটিয়েছি। সে জানায়, সংস্কৃতিগতভাবে সম্পর্কের চীর ধরলেও রক্তের বন্ধন ছিন্ন নয়, সূতরাং মিশুর সন্ধান পাইলে আমরা জানাবো সবাইকে। এদিকে মিশু তার পরিবারের চাপে- প্রলোভনে ও আর্থিক সাপোর্টে যেন ভারতে চলে যেতে না পারে; সে জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের আইনগত সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন মনিকা। এ ব্যাপারে আরাফাত রহমান মিশুর সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মনিকা জানান, মিশু যদি একবার এসে আমাকে বলে ‘তোমার আমার সম্পর্ক আর নেই কিংবা থাকবেনা’ তাও আমি মেনে নিব। কিন্তু আমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারেনা।