নিউজ ডেস্ক:
গেল পয়লা বৈশাখের আগেও ইলিশ ছিল নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। অনেকটা বিলাসিপণ্য হিসেবে ইলিশের অবস্থান ছিল ঢাকাসহ দেশের বড় বড় মাছের আড়ৎগুলোতে।
ইচ্ছা থাকা সত্বেও অনেকে ইলিশ কিনতে পারেননি। কারণ, ক্রয়ক্ষমতা বা সামর্থ্যের বাইরে ছিল ইলিশ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাজারে অন্যসব মাছের চেয়ে ইলিশ সবচেয়ে বেশি সস্তা।
‘ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব’
(ইলিশ, বুদ্ধদেব বসু)।
বর্ষা প্রায় শেষ কিন্তু এখনো চলছে ইলিশ উৎসব। অনেকবছর পর দেশে এই রকম ঘটনা ঘটল। একটা সময় ছিল যখন খুব কম দামে ইলিশ পাওয়া যেত। কয়েক যুগ আগে, বিশেষ করে গত শতাব্দির ষাটের দশকে বাংলাদেশে ইলিশ আহরণ ছিল উল্লেখযোগ্য। আরো দুই একটি দেশে ইলিশ পাওয়া গেলেও বিশ্বে ইলিশের পরিচিতি বাংলাদেশের পণ্য হিসেবেই।
ষাটের দশকে সাগর ও মোহনার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অনেক নদীতেও ইলিশ পাওয়া যেত। ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খাঁ, চিত্রা ও গড়াই নদীতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে এই নদীগুলো থেকে যেন ইলিশ হারিয়ে যেতে থাকল। পরে শুধু বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল, মোহনা, মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চলের জেলাগুলোর নদীতে ইলিশের বিচরণ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ঠিক তখন দেশের অভ্যন্তরীণ নদী থেকে ইলিশ সংগ্রহের ৮০ শতাংশ আসত চার জেলা ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর থেকে।
ইলিশ আহরণের দূরাবস্থার কারণে বদ্ধ জলাশয়েও বাণিজ্যিকভাবে ইলিশ চাষের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে ততটা সফল হওয়া যায়নি। তাই গত কয়েক বছর আহরণ মৌসুমেও ইলিশের দাম ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
আমিষ জাতীয় খাদ্যপণ্য হিসেবে ইলিশ রপ্তানিও হতো এক সময়। কিন্তু যখন উৎপাদন কমে গেলো এবং দেশের মানুষের চাহিদ পূরণে ব্যর্থ হলো তখন বন্ধ করে দেওয়া হলো রপ্তানি। তবে আশা জাগানিয়া কথা হলো, কয়েক যুগ পর ইলিশ তার পুরনো বিচরণ ক্ষেত্রে ফিরতে শুরু করেছে। আর তা সম্ভব হয়েছে সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টা ও জেলেদের সহযোগিতার কারণে। সরকার যে সময় জেলেদের ইলিশ ধরতে নিষেধ করেছে, জেলেরা সে সময়ে ইলিশ না ধরে এই সহযোগিতা করেছে। এই বছরেও সরকারের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সরকার খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে জেলেদের সহযোগিতা করে। এ ছাড়া মা ইলিশের প্রজনন সময়ে ইলিশ আহরণ না করার ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক প্রচারও জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। ইলিশ আহরণে তারা মানছে সরকারের দেওয়া নিয়ম নীতি। তবে ইলিশের বাম্পার উৎপাদনে সরকারি কর্মসূচিই একমাত্র কারণ নয়, অন্যান্য কারণ নিশ্চয় আছে।
জেলেরা বলছেন, ১৯৯১ সালের পর এই বছরই সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। আর মৎস অধিদপ্তরের সূত্র মতে, অনেক বছর পর এবার বাণিজ্যিকভাবে ইলিশ আহরণে নতুন করে তালিকায় এসেছে দেশের আট জেলা। সব মিলিয়ে এই বছর মোট ২৫টি জেলার ১১২টি উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে ইলিশ আহরণ হচ্ছে। আর নতুন করে তালিকায় আসা জেলাগুলোতে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার জেলে বাণিজ্যিকভাবে ইলিশ আহরণ করছে।
১৯৮৩-৮৪ সালের পর থেকে ফিশারিজ রিসোর্স সার্ভে সিস্টেম কর্তৃক দেশে ইলিশ আহরণের সুনির্দিষ্ট রেকর্ড তৈরি শুরু হয়। সেই হিসাব থেকে দেখা যায়, গত শতাব্দির পঞ্চাশের দশকে এই অঞ্চলে ইলিশের আহরণ ছিল এক থেকে দেড় লাখ টন। যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আসত অভ্যন্তরীণ নদীগুলো থেকে। প্রথম পাঁচ সাত বছর দেশের অভ্যন্তরীণ নদীগুলো থেকে সন্তোষজনক ইলিশ আহরণ হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যেমন, ১৯৯১ সালে মোট এক লাখ ৮২ হাজার টন ইলিশ আহরণ হয়। এর মধ্যে ৬৬ হাজার টন ইলিশ আসে অভ্যন্তরীণ নদীগুলো থেকে। ক্রমান্বয়ে তা আরো কমতে থাকে। এই সময়গুলোতে মোট ইলিশ আহরণ বাড়লেও নদী থেকে আহরণ কমতে থাকে। ২০০৬-০৭ সালে মোট দুই লাখ ৮০ হাজার টন ইলিশ আহরণ হয়। যার মাত্র ২৮ শতাংশ আসে নদীগুলো থেকে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ বছর ইতোমধ্যে মোট আহরণের পরিমাণ চার লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ নদী থেকে আহরণ করা হয়েছে প্রায় দুই লাখ টন।
তবে ইলিশের এই মৌসুমে সোমবার শীর্ষস্থানীয় জাতীয় একটি দৈনিকের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন আশাহত করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। প্রথমে জেলেরা খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু সব ইলিশ বিক্রি না হওয়ায় এবং সংরক্ষণ করতে না পারায় জেলেরা এখন হতাশ। আর লবণ ও বরফের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইলিশ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জেলেরা। তাই অনেক জেলেই তাজা মাছ রেখে বাসি মাছ ফেলে দিচ্ছেন। এমনকি সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের কুমিরাঘাট, বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বোয়ালিয়াকুল, সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ফকিরহাট সাগরপাড়ে যেখানে-সেখানে ইলিশ পড়ে আছে। আর তা পঁচে পুরো এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। খালের পানিতেও প্রচুর পঁচা ইলিশ ভাসতে দেখা গেছে।
শুধু তাই নয়, ওই প্রদিবেদনে বলা হয়েছে গত তিন দিন এত বেশি মাছ পড়েছে যে অনেক জেলে জালের কিছু অংশ কেটে সাগরে ফেলে দিয়ে এসেছেন। অনেকে জাল থেকে মাছ খুলতে না পারায় জাল-মাছ একসঙ্গে তীরে নিয়ে এসেছেন।
এদিকে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে গত রোববার পুনরায় মা ইলিশ সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে সরকার। ইলিশ রক্ষায় প্রধান প্রজনন মৌসুমে ‘মা ইলিশ’ সংরক্ষণ অভিযানের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের ২৭টি জেলায় ২২ দিন ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, কেনাবেচা, পরিবহন, মজুদ, বিনিময়সহ সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। এ ছাড়া সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ইলিশের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে রূপালি ইলিশে সুদিন ফিরেছে বলেই বলা যায়। তবে শুধু উৎপাদনে ব্যবস্থা নিলেই চলবে না। সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নিতে হবে সরকারকে। মাছ সংরক্ষণের জন্য দরকার বরফ ও লবণ। আর দরকার অতিরিক্ত শ্রমিক। এই তিন উপাদানের সংকটের কারণেই মূলত চট্টগ্রামে ইলিশ সংরক্ষণ করতে পারছেন না জেলেরা। এই ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
উৎপাদনে ধারাবাহিকতা ধরে রাখার প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইলিশ রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যায় কি না তাও ভাবতে হবে সরকারকে। বলছি না, এই বছরই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিক সরকার। কিন্তু চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হলে তা রপ্তানি করতে তো অসুবিধা নেই। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। সরকারের আয় বাড়বে। তবে পাচার রোধে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
দেশে জেলেদের মধ্যে ইলিশ আহরণের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ইলিশ বেশি বেশি ধরা পড়ছে জালে। আগামীতে ইলিশ উৎপাদন আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়। তাই এর সংরক্ষণ ও রপ্তানির বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ইলিশ, এটা ভাবতেই ভাল লাগে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইলিশ বিদেশে রপ্তানি হোক, ইলিশের মাধ্যমে দেশের নাম আরো একবার ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বজুড়ে।