নিউজ ডেস্ক:
বহুল আলোচিত রমনায় বোমা হামলার দেড় দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। এই মামলা প্রধান আসামি মুফতি হান্নানের অন্য মামলায় ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হলেও রমনায় বোমা হামলা নিষ্পতি না হওয়ায় অন্য আসামিদের দণ্ড কার্যকর করা যাচ্ছে না। উচ্চ আদালতের রায়েই নির্ধারিত হবে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অপর ৭ আসামির ভাগ্য।
তবে রমনায় বোমা হামলার বিচার বিলম্বিত হওয়ায় ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রধান আসামি মুফতি হান্নানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়ে গেছে। এই মামলাটি এতো বিলম্বিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটার বিচারে কি হবে এটা সম্বন্ধে আমি খুবই সন্দিহান। বলতে পারছি না, সত্যি যারা মারা গেছে তারা বিচার পাবে কি না।
কারও নাম উল্লেখ না করে বিলম্বিত তদন্তকে দায়ী করে তিনি বলেন, ফৌজদারী মামলার একটা বিষয়ই হলো ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তদন্ত করা। ঘটনার পর দ্রুততম সময়ে বিচার নিষ্পত্তি করা। কিন্তু যখনই একটি মামলা দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত বা বিচার না হয় সেই বিচারটাই তখন অকার্যকর হয়ে যায়।
তবে এই হামলার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা হামলা করেছে তারা মনে করেছিল এর মাধ্যমে বাঙালিকে আবহমান সংস্কৃতি চর্চা থেকে নিবৃত করা যাবে। কিন্তু ঘটনার পরের বছরই দেখা গেছে রমনার বটমূলে মানুষে সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে।
চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল শুনানি শুরু হয়, যা এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ১৪ মে এই মামলায় পরবর্তী শুনানি হবে। সেদিনই হাইকোর্টের শুনানি শেষ হবে বলে জানিয়েছেন এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইউসুফ মাহমুদ মোরশেদ। তিনি বলেন, উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ১৪ মে দিন নির্ধারণ করেছেন। আশা করছি- সেদিনই শুনানি শেষে আদালত মামলাটির রায়ের দিন নির্ধারণ করবেন বা রায়ের জন্য (সিএভি) অপেক্ষমান রাখবেন।
১৬ বছর আগে বৈশাখী অনুষ্ঠানে এসে নিহত হওয়া স্বজনসহ দেশবাসী উচ্চ আদালতের রায়ের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় করা হত্যা মামলার রায় হয়েছে ওই হামলার প্রায় ১৩ বছর পর ২০১৪ সালের ২৩ জুন। রায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত।
একইবছর বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর ও আরিফ হাসান ওরফে সুমন হাইকোর্টে ফৌজদারি আপিল দায়ের করেন।
এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত মুফতি আবদুল হান্নান, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলাল উদ্দিন, আরিফ হাসান ওরফে সুমন জেল আপিল দায়ের করেন।
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৯ জন। তারা হলেন, আল-মামুন হোসেন, রিয়াজুল ইসলাম, জান্নাতুল ফেরদৌস শিল্পী, আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, মোহাম্মদ এমরান হোসেন, অসীম চন্দ্র সরকার, ইসমাইল হোসেন স্বপন ও আনসার আলী। এক জনের পরিচয় জানা যায়নি। এ ঘটনায় পুলিশ রমনা থানায় মামলা করে। ২০০৬ সালের ১৯ নভেম্বর এ মামলায় মুফতি আবদুল হান্নান আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর ঘটনার জট খোলে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলার তদন্তে গতি সঞ্চার হয়। ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনকে আসামি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে ওই ঘটনায় দুটি অভিযোগপত্র দেয়৷ এর একটি হত্যা ও অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে।
এই ১৪ আসামির মধ্যে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন- মুফতি হান্নান, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলাল উদ্দিন, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মাওলানা তাজউদ্দিন (সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই) এবং হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর বদর। এদের মধ্যে প্রথম চারজন কারাগারে এবং শেষ চারজন পলাতক রয়েছে৷ অপর ছয় আসামিকেই হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। কারাগারে আটক এই ছয় আসামি হলেন- হাফেজ আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির ওরফে আবদুল হান্নান, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আবদুর রউফ ও শাহাদাত উল্লা ওরফে জুয়েল।
একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাটি নিম্ন আদালতে এখনো বিচারাধীন আছে।