বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত চীনের অর্থনীতিতে সংকট চলছে। দেশটির সরকার এই বিষয়টিতে দৃশ্যত এক পাশে রেখে কোভিড নির্মূলের নীতি নেওয়ায় চীনের জনগণের পাশাপাশি কমবেশি ভুগতে হচ্ছে বিশ্বকেও।
চলতি বছর মার্কিন মুদ্রা ডলারের বিপরীতে রেকর্ড পরিমাণ অবমূল্যায়ন ঘটেছে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের। ফলে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির হার দিন দিন বাড়ছে এবং সার্বিকভাবে চীনের অর্থনৈতিক ভারসাম্য খানিকটা টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের মতো মুদ্রাস্ফীতি এখনও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছায়নি তবে অন্যধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে চীনকে। চলতি বছর বিশ্বের কারখানা বলে পরিচিত এই দেশটির শিল্পোৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ফলে, চলতি বছর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল চীনের সরকার, তার কাছাকাছি পৌঁছানেও এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জের ব্যাপার চীনের কাছে।
দেশটির বর্তমান এই সমস্যার জন্য ৫টি কারণকে দায়ী মনে করে বিবিসি। এসব কারণ হলো—
১. জিরো কোভিড নীতি
দেশ থেকে কোভিড নিমূর্ল করতে ‘জিরো কোভিড’ নামের যে কঠোর নীতি চীনের সরকার নিয়েছে, সেটিকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে প্রধান কারণ বলে মনে করে বিবিসি। এই নীতির আওতায় গত বছর থেকে যখন-তখন যে কোনো প্রদেশ বা দীর্ঘ লকডাউন জারি করছে সরকার। ফলে একদিকে যেমন শেনজেন, তিয়ানজিনসহ শিল্পাঞ্চল বলে পরিচিত বিভিন্ন শহরে শিল্পোৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্য ও পানীয়, খুচরা জিনিসপত্র ক্রয় ও ভ্রমণ ব্যাবদ ব্যয় ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে দেশটির সাধারণ জনগণ। এতে দেশটির পণ্য উৎপাদন ও পরিষেবা খাতের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যাপক চাপে পড়েছে।
সরকারি তথ্য অবশ্য বলছে, সেপ্টেম্বরে চীনে শিল্পোৎপদান পুরোমাত্রায় চলেছে, তবে জিরো কোভিড নীতির কারণে জুলাই ও আগস্টে চীনের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে লকডাউন চলায় ওই দুই মাস দেশটির শিল্পোৎপাদন হয়েছে খুবই কম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন—এই মুহূর্তে চীন যদি জিরো কোভিড নীতি ত্যাগ করে, তাহলেও ২০২০ সালে মহামারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত লকডাউনের কারণে শিল্পোৎপাদন খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে চীনের— তা পূরণেও প্রায় এক দশক লেগে যেতে পারে।
চীনের অর্থনীতিবিদ লুইস কুইজস বিবিসিকে বলেন, ‘আপনি যদি শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা সম্প্রসারণ বার বার বাধাগ্রস্ত করেন, সেক্ষেত্রে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।’
২. প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না বেইজিং
গত আগস্টে অবকাঠামো, রিয়েল এস্টেট ও খুচরা ব্যবসা খাতে প্রণোদনা বাবদ ১ ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিল বেইজিং; কিন্তু অর্থনিবিদ লুইস কুইজসের মতে অর্থনীতি মেরামতে বেইজিংয়ের আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।
তিনি বলেন, ‘সরকার যে বরাদ্দ দিয়েছে— তাতে দেশের অবকাঠামো, রিয়েল এস্টেট এবং খুচরা ব্যবসা কোনো রকমে হয়তো টিকে যাবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশি সুফল আনতে সক্ষম হবে না।’
‘অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো দরকার ছিল। বর্তমানে চীনের বিভিন্ন শহরে বাড়িভাড়া বাড়ছে— এটি হ্রাস করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারত, রিয়েল এস্টেট খাতে কর কমানোও প্রয়োজন ছিল।’
‘মোট কথা, একটি ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে একটি যথাযথ পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোনো দরকার ছিল, যা বেইজিং এখনও করেনি।’
৩. সংকটে আছে রিয়েল এস্টেট খাত
চীনের গড় জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) রিয়েল এস্টেট এবং গৃহায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির জিডিপির এক তৃতীয়াংশ আসে এই খাত থেকে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে সাধারণ চীনাদের মধ্যে; এ কারণে আবাসন খাতে বিনিয়োগে উৎসাহ আর আগের মতো দেখা যাচ্ছে না তাদের মধ্যে।
জনগণের এই ব্যাপক অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে দেশটির রিয়েল এস্টেট ও গৃহায়ন বাণিজ্যের ওপরও। ফলে মহামারি শুরুর পর থেকেই মন্দাভাব শুরু হয়েছে চীনের এই খাতে।
সরকার অবশ্য এ পর্যন্ত কয়েক দফায় এই খাতে আর্থিক প্রণোদনা বরাদ্দ করেছে, তবে তাতে বিশেষ সুফল আসেনি।
৪. জলবায়ুগত বিপর্যয়
বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলা দীর্ঘ তাপপ্রবাহ, খরা, ও অতিবৃষ্টিও চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। কারণ এর ফলে একদিকে যেমন দেশটির কৃষি উৎপাদনের ব্যাপক ও সরাসরি ক্ষতি হয়েছে, অন্যদিকে তাপপ্রবাহ ও খরার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা গেছে বেড়ে। ফলে শিল্প-কলকারখানায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে।
এবং প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের সরবরাহ না পাওয়ায় গত কয়েক মাসে চীন থেকে কারখানা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারী বহুজাতিক কোম্পানি ফক্সকোন, টেসলাসহ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি।
চীনের সরকারি পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম ৭ মাসে চীনের লোহা ও ইস্পাত কারখানাগুলো লোকসানের পরিমাণ ছিল ৮০ শতাংশ।
৫. চাকরি হারাচ্ছে চীনা তরুণ-তরুণীরা
জিরো কোভিড নীতি ও বিদ্যুৎ সরবরাহজনিত সমস্যার কারণে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি চীন থেকে তাদের কারখানা ও মূলধন গুটিয়ে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া শুরু করায় বেকারত্ব বাড়ছে দেশটিতে। বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতে চাকরি করা লাখ লাখ তরুণ-তরুণী গত কয়েক মাসে চাকরি হারিয়েছেন। চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম প্রতি ৫ জন তরুণ-তরুণীর মধ্যে একজন সম্পূর্ণ বেকার। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই বেকারত্বের সার্বিক ও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে চীনের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায়।