হাবিবুল ইসলাম হাবিব, টেকনাফ : সীমান্তবর্তীদেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতন হওয়ার কারনে মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুরা পালিয়ে এসে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় শরণার্থী ক্যাম্পসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গার। তাদের সঙ্গে থাকা শিশুদের অবস্থা ঝুঁকিতে। বেশির ভাগ শিশুর মায়েরা না খেয়ে দীর্ঘপথ হেঁটে বাংলাদেশে আসায় তাদের অবস্থাও গুরুতর। এ কারণে শিশুকে বুকের দুধ দিতে না পারায় শিশুদের অবস্থা হাড্ডিসার। শত শত শিশুর শরীর জ্বরে পুড়লেও কোলে নিয়ে বসে থাকা ছাড়া মায়েদের কিছু করা নেই। তার উপর সবখানে পানি বাহিত রোগ ডায়রিয়া, আমাশয়, নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ায় শিশুদের অবস্থা আরও চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারি ও এনজিও সংস্থাগুলো স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকলেও বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির জন্য এ সেবা নিতান্তই অপ্রতুল বলে জানা গেছে।
সুত্রে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে আসা প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গার মধ্যে অর্ধের বেশিই শিশু, যা এবার আসা মোট শরণার্থীর ৭৫ শতাংশ। এদের মধ্যে অনেক শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এসব শিশুর সাহায্যের দরকার। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৪ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর ঝুঁকিতে থাকার কথা জানিয়েছে।
জাতিসংঘের এ সংস্থার শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান জ্যঁ লিবি জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ঢাকা থেকে ইউনিসেফের সহায়তার জরুরি সামগ্রী কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে ক্যাম্পগুলোয় সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা দরকার।
গতকাল ১৭ সেপ্টেম্বর টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। সেখানে দেখা গেছে রোহিঙ্গা নারীরা খাল-বিল, নদী-নালার জমাট বাধা পরিত্যক্ত অপরিচ্ছন্ন পানিতে তাদের ব্যবহৃত কাপড় চোপড় ও থালা বাসন পরিষ্কার করছেন। আবার একই পানিতে মলমূত্র ত্যাগ করছেন। শরণার্থী শিবিরগুলো প্রতিদিনই বড় হচ্ছে এবং সেখানে সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। পানিবাহিত কোনো রোগ যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য চেষ্টা করা হলেও এত এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে বহু নারী, শিশু ও বৃদ্ধ অল্প জায়গার মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের শিশুরা পানিবাহিত রোগের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা: টিটু শীল জানান, ‘অপরিচ্ছন্ন পানি ব্যবহার করলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাছাড়া সুপেয় পানির অভাবে শিশুরা পানিবাহিত রোগে আকান্ত হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ডায়েরিয়া ও আমাশায় আক্রান্ত হয়ে টেকনাফ হাসপাতালে আসা প্রতিদিন অসংখ্য শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
লেদা এলাকায় আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, পার্শ্ববর্তী বসতবাড়িতে টিউবয়েল থাকলেও রোহিঙ্গাদের চাহিদা বেশি থাকার কারণে ঠিকমত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গা নারীরা খাল ও ছরার পানি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ কর্ম সারছেন। এর ফলে পানি বাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে তাদের। একই বস্তির খুরশিদা বেগম জানান, পানি ও খাবারের অভাবে তার পরিবারে চার শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এ সময় তিন বছর বয়সী শিশু আছিফাকে নিয়ে মা শরিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিবেদককে জানান, তিন দিন ধরে তার মেয়ে জ্বর ও ডায়েরিয়ায় ভুগছেন। স্থানীয় বেশ কয়েকজন ওই মহিলাকে চিকিৎসার জন্য টাকা দিতে দেখা গেছে। এছাড়া উপজেলার ইউনিয়নে আশ্রয় নেওয়া প্রতিটি বস্তিতেও এমন চিত্র দেখা গেছে।
টেকনাফ উপজেলা রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাইছার পারভেজ চৌধুরী জানান, প্রায় ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শিশুর জন্য জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। এছাড়া শরণার্থী শিবিরগুলোতে সুপেয় পানি ও সেনিটেশনের ব্যবস্থা করা না হলে ভয়াবহ পরিবেশের শিকার হতে পারে রোহিঙ্গা শিশুরা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক জানান, গত সাপ্তাহ থেকে কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ক্যাম্পগুলোতে সুপেয় পানি সরবরাহ করছে।