হাবিবুল ইসলাম হাবিব, টেকনাফ: মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে গত ২৫শে আগস্ট শুরু হওয়া নির্বিচার হত্যার তা-বে রোহিঙ্গা নিধনে নেমেছে মিন অং হ্লাইংয়ের মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সঙ্গে আছে রাখাইন বৌদ্ধরা। এবার নতুন করে পালিয়ে এসেছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। টেকনাফের নয়াপাড়া, এবং উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে তাদের নাম নিবন্ধন শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। দেয়া হচ্ছে ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র। কিন্তু এই রোহিঙ্গা নিবন্ধনে চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। তাতে জাতিগত পরিচয় হিসেবে রোহিঙ্গা শব্দটি উল্লেখ না করায় এদেশে এসেও পরিচয় সংকট সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে পড়ছে বলে মনে করছে অনেক রোহিঙ্গা। শুরুতে বিতরণ করা ছবিযুক্ত পরিচয়পত্রের নাম ছিল ‘রোহিঙ্গা পিপলস্ রেজিষ্টেশন’। পরে সে নাম পরিবর্তন করে হয় ‘মিয়ানমার ন্যাশনালস্ রেজিষ্টেশন’। প্রথম দিকে তাদের জাতীয়তা লেখা হয়েছিল ‘রোহিঙ্গা’। পরে তাতেও পরিবর্তন আসে। শেষে লেখা হয় জাতীয়তা ‘মিয়ানমার’। সেক্ষেত্রে জাতি গোষ্ঠী হিসেবে পৃথক কলামে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয় লেখা হয়েছিল। এতেই শেষ হয়নি অসংলগ্নতার। প্রথমদিকে প্রদেশের নাম ‘আরাকান’ লিখলেও পরে তাতেও আসে পরিবর্তন। এখন লেখা হচ্ছে ‘রাখাইন প্রদেশ’।
এদিকে পরিচয়পত্রে তাদের জাতিগত পরিচয় ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করায় তারা বেশ হতাশ। এতে তাদের সুদীর্ঘ জাতিগত ইতিহাসের মৃত্যু ঘটছে বলে মনে করছে রোহিঙ্গারা। জাতিগত যে পরিচয়ের জন্য এত কিছু হচ্ছে বাংলাদেশে আসার পরও এভাবে তাদের সেই আদি পরিচয় কেড়ে নেয়া হচ্ছে জানান শতাধিক রোহিঙ্গা। তাদের রোহিঙ্গা পরিচয় উল্লেখ করা না হলে অনেকেই শরণার্থী হিসেবে নাম নিবন্ধন করবে না বলে জানান। আবার হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ বায়োমেট্রিক করার বয়ে কক্সবাজার জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। বায়োমেট্রিকে রোহিঙ্গা না লেখায় অনেকে নিবন্ধন করার লাইনে দাঁড়িয়েও ফিরে যাচ্ছেন।
গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১ টা। টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের প্রবেশ পথ। এদিক-ওদিক আসা-যাওয়া করছে শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু। নাম নিবন্ধন হচ্ছে কিনা জানতে চাইলেই দাঁড়িয়ে পড়েন কয়েকজন। এরই মধ্যে এগিয়ে আসেন আরাকান রাজ্য থেকে আসা একজন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা পরিচয় দিয়ে গত বৃহস্পতিবার নাম নিবন্ধন শুরু হয়েছিল। তাই গত শুক্রবার লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। কাছে গিয়ে যখন দেখলাম যে, সেই পরিচয়পত্রে রোহিঙ্গা পরিচয় লেখা হচ্ছে না তখনই নিবন্ধন না করে বের হয়ে এসেছি। রোহিঙ্গা শরণার্থী না লিখলে নিবন্ধন করবো না।
সুত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সকালে নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে নিবন্ধন শুরু হয়। দেয়া হচ্ছে ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র। সেই পরিচয়পত্রের নাম দেয়া হয়েছে ‘রোহিঙ্গা পিপলস্ রেজিষ্টেশন’। তাতে নাম, বয়স, পিতা, মাতা, জন্ম তারিখ, ধর্ম, জন্মস্থান, দেশ, জাতীয়তা, নিবন্ধনের তারিখ, ঠিকানাসহ ১২টি তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয়তা রোহিঙ্গা এবং জন্মস্থান ও দেশ উল্লেখ করা হচ্ছে মিয়ানমার। আর ধর্ম ইসলাম। ওই দিন দুপুর পর্যন্ত তাদের জাতীয়তা হিসেবে রোহিঙ্গা পরিচয়টি উল্লেখ করা হয়।
এই তথ্য জানিয়ে আকিয়াব জেলার মংডুর মেরুল্লা থেকে আসা নুরুল ইসলামের ছেলে আবদুল আমিন বলেন, আমি শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নাম নিবন্ধন করি। নিবন্ধন নম্বর ১০৫২০১৭০৯১৪১২৩১৫৩। আমার পরিচয় হিসেবে রোহিঙ্গা লেখা হয়েছে। কিন্তু একই দিন বিকাল থেকে সেই স্থানে লেখা হচ্ছে মিয়ানমার। যে পরিচয়ের জন্য আমাদের এত কিছু হারাতে হচ্ছে, রক্ত-জীবন-সমস্ত দিতে হচ্ছে তাই অস্বীকার করা হচ্ছে। তা মেনে নেয়া যায় না। তার পরে নিবন্ধন করা কয়েকজনের পরিচয়পত্রে ১৩টি তথ্য সংযুক্ত করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে জাতি গোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গা এবং জাতীয়তা হিসেবে মিয়ানমার লিখতে দেখা গেছে।
একই দিন বিকাল ৫টা ৩৮ মিনিটে নাম নিবন্ধন করেন নূরা খাতুন। তার নিবন্ধন নম্বর ১০৫২০১৭০৯১৪১৭২৬৫৮। ৫০ বছরের এই বৃদ্ধা মংডুর গোরাখালী থেকে নয়াপাড়া ক্যাম্পে আসেন। তার জন্মস্থান, দেশ এবং জাতীয়তা এই তিন কলামেই মিয়ানমার লেখা হয়েছে। এতে তিনি মনঃক্ষুণ্ন। নূরা বলেন, আমরা রোহিঙ্গা মুসলমান। আমাদের সেই পরিচয় আমরা চাই। এমন জানলে আমি ওই কার্ড নিতাম না।
একই ইস্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মংডুর মংনিপাড়ার বাসিন্দা শাহ আলম। তার বয়স ৪২। গতকাল দুপুর ১২টা ৩২ মিনিটে তিনি নিবন্ধনভুক্ত হন। তার রেজিষ্টেশন কার্ডও নূরার মতোই। এখন সেভাবেই তাদের নিবন্ধন করে কার্ড দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার তো বার বার আমাদের বাঙালি পরিচয় দিয়ে কার্ড দিতে চেয়েছিল। রোহিঙ্গা মুসলমান হিসেবে না দেয়ায় আমরা নিই নি। বাপ-দাদার আমল থেকেই আমাদের রোহিঙ্গা পরিচয় বিশ্ববাসী জানে। এখানেও আমাদের পরিচয় সংকট তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতিকে তিনি তার নিরীহ জাতির প্রতি ধারাবাহিক পীড়নের অংশ বলেই মনে করছেন।
তার কথায় সম্মতি জানিয়ে পাশে দাঁড়ানো রোহিঙ্গা যুবক নুরুল হক , মো. ওসমান, নুর কামাল বলেন, এজন্যই আমরা নাম নিবন্ধন করিনি। রোহিঙ্গা পরিচয় উল্লেখ না করলে তা নিবো না। তবে অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে নাম নিবন্ধনের জন্য লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে আলাপ শুনে পাশের পথচারী রোহিঙ্গারা দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শতাধিক রোহিঙ্গার ভিড়। তাদের মধ্যে রয়েছেন শেফায়েত, মোনাফ, আতাউর, নূর, মোস্তফা, হামিদ, মজিদ, মতলব, গফুর, সোনা আলী, কবির আহম্মদ, শাহানা, হাফিজ, আকতার ও রশিদসহ অনেকেই। তারা সমস্বরে বললেন, হাজার বছরের যে ঐতিহাসিক পরিচয় বাপ-দাদারা আমাদের জন্য রেখে গেছে তা আমরা ভুলে যেতে পারি না। বর্মীরা আমাদের সে পরিচয় মুছে দিয়ে বাঙালি বানিয়ে এদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এদেশ আমাদের ক’দিন রাখবে। এখন আমাদের আদি পরিচয় মুছে দেয়া হলে শুধু আমাদেরই চরম ক্ষতি হবে না কোনো সময় আমরাও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বলে উল্লেখ করতে পারবো না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠান বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তা এবং নয়াপাড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ (নিবন্ধন) লে. কর্নেল জাওয়াদ চৌধুরী বলেন, গত বৃহস্পতিবার এ ক্যাম্পে ও তার দু’দিন আগে কুতুপালং ক্যাম্পে নতুন আসা শরণার্থী নিবন্ধন শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যখন যে সিদ্ধান্ত আসছে তা অনুসরণ করছি।
টেকনাফ ২ বিজিবি অধিনায়ক লে: কর্ণেল আরিফুল ইসলাম জানান, প্রথমদিকে রোহিঙ্গা পরিচয় এবং আরাকান রাজ্যের নাম লেখা হলেও পরবর্তীতে উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে মিয়ানমারের জাতীয়তা উল্লেখ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা যে মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থী সে অর্থে কোনো ব্যত্যয় ঘটছে না।