‘বর্ণনা করতে গেলে চোখে পানি চলে আসছে। আমি একা, আমাকে ১০-১৫ জন ধরে মারবে, এটা ভাবতে পারিনি। কথা বলার আগেই ধরে ধরে মারা হয়েছে। আমি ভাবিনি, আমি বেঁেচ ফিরব। কারণ তাদের হাতে রাম দা’সহ অস্ত্র ছিল। পাশ থেকে বলা হচ্ছে, গুলি কর, জবাই কর, মেরে ফেল। সাধারণ ছাত্রদের যে এভাবে মার খেতে হবে কল্পনার বাইরে।’
এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থী হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন করলেই ঝামেলা। কোথাও আন্দোলন করতে দেবে না, দাঁড়াতে দেবে না। আমরা যেখানেই আন্দোলন করার চেষ্টা করেছি, আমাদেরকে সেখানেই বাঁধা দেয়া হয়েছে।’
প্রায় এক মাস পর এই প্রথম চুয়াডাঙ্গা জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার শিকার শিক্ষার্থীরা মুখ খুললেন। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় চুয়াডাঙ্গা শহরের তিন তারকা মানের হোটেল সাহিদ প্যালেসে ‘অভিজ্ঞতা : ঘটনার বর্ণন’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লোমহর্ষক হামলা ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের গল্প শোনান এই শিক্ষার্থীরা। এসময় চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে হামলার শিকার হয়ে আহত, কারাবরণকারী শিক্ষার্থীরা আবেগঘন বক্তব্য দেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে কথা বলেন ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হওয়া চুয়াডাঙ্গার সন্তান শাহরিয়ার শুভ’র পিতা।
২৩চকআন্দোলনের অন্যতম এবং আহত ছাত্রী অনিমা ইসলাম বলেন, ‘আগস্টের ৪ তারিখে আমি বেঁচে থাকব, এই আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ৪ তারিখে আমি আন্দোলন করায় আমাকে যেভাবে খুঁজে বেড়ানো, হুমকি দেয়া হয়, তাতে এটা না ভেবে উপায় ছিল না। ৪ তারিখে আন্দোলনে ছাত্রলীগ পিছন থেকে হামলা করে। আমি ভাবতেই পারিনি, ওরা পেছন থেকে মারবে। ওই সময় অনেক পরিচিত মুখ আমাদেরকে মারধর করেছে। আমাদের যখন মারধর করা হয়, তখন অনেক বাপ-চাচার বয়সী মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। খুব লজ্জা করে তাদের কথা ভেবে। হয়ত ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। একটি বেসরকারি হাসপাতালের লোকজন আমাদের সহযোগিতা করেছিল। তাদেরকেও খুঁজে বেড়ানো হয়েছে। নির্যাতন করা হয়েছে। আমাদেরকে নোংরা ভাষায় হুমকি দেয়া হয়। আমি কখনো ভাবিনি, আমার জীবনে এরকম একটি রাত আসবে। হুমকির পর হুমকি। এখনো দেখলে বলে ওই সেই মেয়েটা। আপনাদের বলতে চাই, আপনারা যেখানে অন্যায় দেখবেন, প্রতিবাদ করবেন।’
চুয়াডাঙ্গার আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্বদানকারী হাসনা জাহান খুশবু বলেন, ‘যেখানে দাঁড়াতে গেছি, সেখানেই অ্যাটাক করা হয়েছে। মেয়েদেরকেও ছাড় দেয়া হয়নি। স্কুল-কলেজের মেয়েদের পশুর মতো মারধর করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার বর্বরতা সারা দেশকে ছাড়িয়েছে। স্কুল-কলেজের মেয়েদেরকে নির্মমভাবে মারধর করা হয়েছে।’
আন্দোলনের অন্যতম সাহসী সহযোদ্ধা আহত সিরাজুম মনিরা বলেন, ‘৪ তারিখে আমরা কোর্ট মোড়ে যখন অবস্থান করছিলাম, তখন বারবার আমাদের বের করে দেয়া হচ্ছিল। ছাত্রলীগের ছেলেরা বের করে দিয়েই ক্ষ্যান্ত না। তারা আমাদেরকে মারবে। আমরা লাইফের রিক্স নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলাম। তাই তাদের ভয়ে চলে যেতে চাইনি। পরিচিত মুখগুলো যখন হামলা করলো, আমি হতচকিত। সেদিনই প্রথম আমি চোখের সামনে কাউকে কোপানো দেখলাম। আমি আজকে ডান হাত দিয়ে মাইক্রোফোন ধরে আছি, আলহামদুলিল্লাহ। আমার হাত এখনো ফুলে আছে। রক্তজমাট বেঁধে আছে। রড দিয়ে মারা হয়েছে। বাজেভাবে আঘাত লেগেছে। হাড়ের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে। তাদের একটাই টার্গেট ছিল, আমাদের মাথায় মেরে শেষ করে দেয়া। বাসায় গিয়ে ছাত্রলীগের ছেলেরা হুমকি দিয়ে এসেছে। সেটা পাশের বাসার লোকজন ভিডিও করছে সন্দেহে, ছাত্রলীগের লোকজন তার বাড়িতেও হামলা করেছে। আমি রাজনীতি বুঝি না, আমি ন্যায়ের পক্ষে। রাত সাড়ে ১১টার দিকেও বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে। এখনো তারা হুমকি দিচ্ছে। আমরা এদের বিচার চাই।’আলমডাঙ্গায় নেতৃত্বদানকারী আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের ছাত্র আরাফাত হোসেন বলেন, ‘৩ তারিখে মুন্সিগঞ্জে আন্দোলনে নেমে আমাদের ৩ জন শিক্ষার্থী বেধড়ক মারধরের শিকার হয়। পরদিন আলমডাঙ্গাতে কর্মসূচি দিলে ছাত্রলীগের ছেলেরা পুরো আলমডাঙ্গা শহর ঘিরে রাখে। তাদের মধ্যে অনেকের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল। ছাত্ররা আসতে গেলে প্রত্যেকের ফোন চেক করে। যাদের প্রোফাইল লাল ছিল, তাদেরকে ধরে ধরে মারধর করা হয়। এমন বর্বর আঘাত আমি আগে কখনো সরাসরি দেখিনি। একটুও মায়া-দয়া ছিল না। আমার চোখের সামনে দেখা, মারতে মারতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপরও মারা বন্ধ করা হয়নি। বুকের ওপর উঠে আঘাত করা হয়েছে। তার তিনটা বুকের হাড় ভেঙ্গে গেছে, হাত ভেঙ্গে গেছে। একজন পড়ে আছে, তারপরও তাকে আঘাত করা হয়। বর্ণনা করাও আমাদের জন্য কষ্টকর।’
কারাবরণকারী শিক্ষার্থী শাহরিয়ার প্রান্ত বলেন, ‘আমাকে মিথ্যা মামলায় আটক করা হয়েছে। মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। নানা রকম ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে।’
চুয়াডাঙ্গা জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ‘অভিজ্ঞতা : ঘটনার বর্ণন’ শিরোনামে গতকাল বুধবার শিক্ষার্থীরা প্রথম এই ভিন্ন আয়োজন করেন। চুয়াডাঙ্গা শহর, সরোজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ভালাইপুর, আলমডাঙ্গা, দর্শনা ও জীবননগরসহ জেলার যেখানে যেখানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন, সেখানেই তারা হামলার শিকার হন। হামলার শিকার শিক্ষার্থীরা নানাভাবে মানসিক নিপীড়নের শিকার হন, সেটিও উঠে আসে এই আয়োজনে। শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণে গণমাধ্যমকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও আইনজীবীরা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীরা তাদের এবং তাদের পরিবারের ওপর বিভিন্ন চাপের বিষয়টিও তুলে আনেন এ অনুষ্ঠানে।অনুষ্ঠানে আইনজীবীদের মধ্যে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. মারুফ সরোয়ার বাবু ও অ্যাড. মানি খন্দকার। গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক প্রবীণ সাংবাদিক আজাদ মালিতা, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি রাজীব হাসান কচি, জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব অ্যাড. মানিক আকবর ও এম এ মামুন।
এ আয়োজনে শিক্ষার্থীদের পাশে শুরু থেকেই ছিলেন চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান, এনআরবি ওয়ার্ল্ডের প্রেসিডেন্ট ও সাহিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক। তিনি এই অনুষ্ঠানে মুঠোফোনে যুক্ত হয়ে পুনরায় শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার অভিব্যক্তি জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গার শিক্ষার্থীদের পক্ষে সাফফাতুল ইসলামের সঞ্চালনায় এসময় উপস্থিত ছিলেন দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিপুল আশরাফ, জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সেলিম, সিনিয়র সাংবাদিক এম এম আলাউদ্দীন, দৈনিক আকাশ খবর পত্রিকার সম্পাদক জান্নাতুল আওলিয়া নিশি, সিনিয়র সাংবাদিক রফিক রহমান, সাংবাদিক জামান আক্তার, মশিউর রহমান, মাহফুজ মামুন, মফিজ জোয়ার্দ্দার, জিসান আহমেদ, মেহেরাব্বিন সানভী, শামসুজ্জোহা রানা, রুদ্র রাসেল, পলাশ উদ্দীন, সাইফুল ইসলাম, সাকিব, ফাহিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব চুয়াডাঙ্গার সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা ইকবাল হৃদয় প্রমুখ।
আবেগঘন বক্তব্য দেন আন্দোলন করে মিথ্যা মামলায় চুয়াডাঙ্গায় কারাবরণকারী শিক্ষার্থী শাহরিয়ার প্রান্ত। আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্রী সিরাজুম মুনীরা, হাসনা জাহান খুশবু, মহিলা কলেজের অনিমা ইসলাম, ভাংবাড়িয়া গ্রামের আসাদুজ্জামান, আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের ছাত্র আরাফাত হোসেন, সরোজগঞ্জ তেঁতুল শেখ কলেজের ছাত্র তানজিল হোসেন, আলমডাঙ্গা এম এস জোহা ডিগ্রি কলেজের হারুন অর রশিদ, বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তামিম হোসেন, দামুড়হুদার তাসলিম আল মাহমুদ, সরোজগঞ্জের সাব্বির আহমেদ, হাটবোয়ালিয়ার মাহফুজ আনাম, মুন্সিগঞ্জের উৎসবসহ আন্দোলনে চুয়াডাঙ্গাতে এবং ঢাকায় সরাসরি অংশ নিয়ে নানাভাবে আহত হওয়া শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও বক্তব্য দেন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়া শাহরিয়ার শুভ’র পিতা আবু সাঈদ। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারাতে বসা শিক্ষার্থী আল মেরাজকে জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে সম্মান জানান শিক্ষার্থীরা।
‘অভিজ্ঞতা: ঘটনার বর্ণন’ অনুষ্ঠানে আহত শিক্ষার্থীরা করুণ ইতিহাস তুলে ধরে বক্তব্য দেন। কীভাবে তাদেরকে মারধর করা হয়েছে, তাদের পরিবারের সদস্যদের কীভাবে হুমকি দেয়া হয়েছে, সেসব নির্মম ঘটনার বর্ণনা দেন শিক্ষার্থীরা। আইনজীবীরা শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। বিচারের জন্য মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিনা পয়সায় সকল প্রকার সহযোগিতা করার কথা দেন। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দ্রুতই মামলা করা হবে বলেও অনুষ্ঠানে জানানো হয়।