নিউজ ডেস্ক:
নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এর হার ১৫ শতাংশই থাকছে। এ কারণে দ্রব্যমূল্যের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে ব্যবসায়ীদের অন্যভাবে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
শনিবার বিকেলে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতা পর্যালোচনা করেন এবং এ নিয়ে সারাদিন কর্মব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। এরই ফাঁকে তিনি কয়েকটি গণমাধ্যমের সাংবাদিকের সঙ্গে বাজেট প্রসঙ্গে আলোচনাকালে এসব কথা বলেন। এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন কারণে ভ্যাটের হার কিছুটা কমানোর চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আগের অবস্থানে রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশই থাকছে। কারণ শুরু থেকেই এটা আছে। তবে অনেককে ভ্যাটের আওতা থেকে বের করে নিয়ে আসা হবে। ভ্যাটের হার কমালে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতো।
বাজেটের আকার কেমন হবে জানতে চাইলে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এবারের বাজেট চার লাখ কোটি টাকার চেয়ে কিছুটা বেশি হবে। নির্দিষ্ট অঙ্কটা বলছি না। মানবসম্পদে আগের চেয়ে অনেক বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে ও বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি খাত আগের মতোই থাকছে।
মন্ত্রী আরো বলেন, এই সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে ৯৫ হাজার কোটি টাকা থেকে বাজেটকে চার লাখ কোটি টাকার বেশিতে নিয়ে যাওয়া। এরপরের বাজেট ৫ লাখ কোটি টাকার মতো হবে বলে দৃঢ়তার সঙ্গে জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে যাদের বাৎসরিক টার্নওভার ৮০ লাখ টাকা তাদের ৩ শতাংশ হারে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগামী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে টার্নওভার এক কোটি টাকার ওপর নির্ধারণ করা হবে এবং ছাড়ের হারও কিছুটা বাড়বে। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন।
আগামী ১ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন। বেলা দেড়টায় শুরু হয়ে ইফতারের আগেই বাজেট বক্তৃতা শেষ করবেন। এবার তার বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম হবে ‘উন্নয়নের মহাসগরে বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের’। আগামী ২৯ জুন সংসদে বাজেট পাস হবে।
মুহিত বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ছিলাম। ২০১২ সালে এ আইনটি পাস হয়েছে। আমরা ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলাম। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। ভ্যাট হার নিয়ে তারা যা ভাবছে তা ঠিক নয়।
রাজস্ব আদায় প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে আট লাখ নিবন্ধিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও ভ্যাট দেয় মাত্র ২৫ থেকে ২৬ হাজার। এই সংখ্যাটি আগামী বছর দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা হবে। আর এ জন্য যা যা দরকার তা করা হবে।
বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজারে বিভিন্ন পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে ভ্যাটের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি যতবার বাজেট দিয়েছি একমাত্র বিএনপি ছাড়া আর কেউ বাজেটের প্রতিবাদ করেনি। কারণ বাজেটের কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়েনি।
করযোগ্য আয়ের সীমা নির্ধারণ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছরই বাজেটের আগে করযোগ্য আয়সীমা নিয়ে বেশ কথা হয়। বর্তমানে এটি আড়াই লাখ টাকা আছে। এবারও করযোগ্য আয়সীমা নির্ধারণ করা হবে। আর যেটি নির্ধারণ করা হবে সেটি স্থায়ী কর যোগ্য আয়সীমা হবে। ভবিষ্যতে এটার আর কোনো পরিবর্তন হবে না।
অর্থমন্ত্রী বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর আমাদের বেশি জোর দেওয়া উচিত। তবে এরই মধ্যে আমাদের দক্ষতা অনেকটা বেড়েছে বলেই আজ আমরা চার লাখ কোটি টাকার ওপর বাজেট দিতে সাহস দেখাতে পারছি। মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর আমাদের নজর থাকবে তবে আগামী বাজেটে পরিবহন ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হবে।
মুহিত বলেন, আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যার প্রতিবন্ধী রয়েছেন। এরা পরিবারের এক ধরনের বোঝা হিসেবে বেঁচে আছে। আমরা এদের প্রতি সহযোগিতার আরো বেশি করে বাড়নোর দিকে নজর দেবো। এদের সংখ্যা অনেক বেশি।
কৃষি খাতের উন্নয়ন সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, কৃষি খাতে আমাদের অসাধারণ উন্নতি হয়েছে। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কৃষকদের। তাদের হাড়ভাঙ্গা শ্রমে আজ আমাদের কৃষির এই উন্নতি। আমাদের কৃষিমন্ত্রীর কৃষি খাতের জন্য তেমন চাহিদা নাই। সার্বক্ষণিকভাবে কৃষি উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কৃষি খাতের উন্নয়নে তিনি যখন যা চান তা দেওয়া হয়। এবারেও তা অব্যাহত থাকবে।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতি অর্থবছরই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। এ বছরও তা অব্যাহত থাকবে। তবে স্বাস্থ্য খাত খুবই ভালো করছে। বিশেষ করে কমিউনিটি হাসপাতালগুলো এখন খুব ভাল করছে। আর এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে জন্মকালীন মৃত্যুহার অনেক কমে গেছে। একইসঙ্গে স্বাভাবিক জন্মহার অনেক বেড়েছে। এর ফলে আমাদের মৃত্যুহার কমে গড় আয়ু বেড়েছে। এসবই একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন যেসব খাতে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হবে তাও তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হবে। দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হিন্দুরা অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে সরকারি সহায়তার দিক থেকে। বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে এ বরাদ্দ ব্যয় করতে পারবেন তারা। করপোরেট ট্যাক্স আগের মতই থাকবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনির উপকারভোগী এবং ভাতা বাড়ানো হবে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, অনুন্নত এলাকাগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। চর এলাকার মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ থাকবে। আগের মতই দেশীয় শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটের পর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। বিশ্বের কোথাও এত কম পয়সায় গ্যাস পাওয়া যায় না। আগামী বছর থেকে এলএনজি প্রকল্প চালু হবে। সিলিন্ডারজাত গ্যাস সরবরাহ বাড়লেই পাইপ লাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন। এ ছাড়া বাজেটের পর জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবেন বলে তিনি জানান।
দেশ থেকে অর্থ পাচাররোধে আগামী বাজেটে কোনো পদক্ষেপ থাকছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে মুহিত বলেন, টাকা পাচাররোধে করণীয় নিশ্চিত করতে একটি কমিটি আছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন সম্পন্ন হয়েছে। কঠিন বিধান রেখে এ আইন অনুসরণ করা হলে অর্থপাচার অনেকটা কমে আসবে।
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এতদিন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেকটা স্থবিরতা বিরাজ করছিল। হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আর জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে এক অন্ধকারময় জায়গায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এখন আর সে অবস্থা নাই আর তারা কোনোদিন ফিরে আসতে পারবে না। এখন দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে করি। বাজেটের পর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনঃনির্ধারণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখতেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি এখনো সে স্বপ্ন দেখি। আর এটা সম্ভব। আমরা দেশ থেকে অতিদারিদ্র্যের হার কমিয়ে এনেছে। এটি যেদিন ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে সেদিন এ দেশ কল্যাণমূলক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে এটি একটি বিষফোঁড়া। একশ্রেণির প্রভাবশালীরা তাদের প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয় না। এ সংস্কৃতি দূর করা না গেলে তা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য এরহার আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। মূলত দুর্নীতির কারণেই দেশে ঋণ খেলাপী সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। সুশাসন কায়েমের মাধ্যমেই এটা দূর করা সম্ভব।
দেশ থেকে তামাকজাতপণ্য বিশেষ করে বিড়ি ও সিগারেট চিরদিনের জন্য বিতাড়িত করার প্রত্যয় জানিয়ে তিনি বলেন, দেশ থেকে চিরতরে বিড়ি ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে। অন্যান্যবার বাজেটের আগে অনেক সংসদ সদস্য গরীব শ্রমিকদের অজুহাত দেখিয়ে নানা ধরনের তদবির করতেন। গত বছর বাজেটে তাদের কথা না শোনায় এবার মাত্র একজন বিড়ির জন্য সুপারিশ করতে এসে ছিলেন।
অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একদিকে যেমন সরকারের সফলতা রয়েছে, অন্যদিকে তার নিজস্ব ব্যর্থতাও রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের সফলতা প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে। অন্যদিকে দীঘদিনের স্বপ্ন ছিল শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন করা। কিন্তু তিনি তা পারেননি। একই সঙ্গে জেলা বাজেটও দিতে পারেননি। তবে একদিন দেশে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবুল মাল আবদুল মুহিত আর অংশ নেবেন না বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছেন। শনিবার এ বিষয়ে তার অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আমার সিদ্ধান্তে এখনো অটল আছি। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সিলেট থেকে নির্বাচন করলে আমি তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবো।