নিউজ ডেস্ক:
পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে প্রতিবছরই দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এবারো যেন ব্যতিক্রম ঘটছে না। এরই মধ্যে মসলার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। বেড়েছে এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, রসুন, আদা, শুকনো মরিচ, হলুদ, জিরা ও তেজপাতার দাম।
খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, উৎসব মৌসুমের অতিরিক্ত চাহিদার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে পাইকাররা বলছেন, আমদানি পণ্য হওয়ায় এ সময়ে চাহিদা বেড়ে যায়, তাই দামও বেড়ে যায়। তবে ক্রেতা ও সাধারণ জনগণের মতে, এর সবই অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি। সরকার তদারকি কার্যক্রম জোরদার করলে এ ধরনের অসাধু দৌরাত্ম বন্ধ হয়ে যেত।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রমজান মাস এবং কোরবানির ঈদ এলেই দেশে মসলার দাম বেড়ে যায়। অন্য সময়ে বরং কিছু কিছু মসলার দাম কমতেও দেখা যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১১ সালের নভেম্বরে দেশে এলাচ ১২শ’ থেকে ২ হাজার টাকা, জিরা ৪৪০ টাকা, দারুচিনি ২৪০ টাকা, লবঙ্গ ১ হাজার ৪৫০ টাকা, সাদা গোলমরিচ ১ হাজার ২৮০ টাকা, কালো গোলমরিচ ৮৬০ টাকা, জয়ফল ১২শ’ টাকা, আলু বোখারা ৫৫০ টাকা, কিসমিস ৬শ’ টাকা, পেস্তা বাদাম ৬২০ টাকা এবং শাহজিরা ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তখন দেশে কোরবানির ঈদের বাজার চলছিল। এরপর ২০১২ সালের জানুয়ারিতেই অর্থাৎ ঈদের দেড় মাস পর প্রায় সব পণ্যের দাম কমে আসে। এলাচ বিক্রি হয় এক হাজার থেকে ১৮শ’ টাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিনের ব্যবধানে দেশে এলাচের দাম বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া বেশির ভাগ এলাচ আসে ভারত থেকে। বর্তমানে দেশটিতে এলাচের দাম বাড়তি, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে।
ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর প্রতিবেদন অনুসারে, স্থানীয় বাজারে বাড়তি চাহিদার কারণে পণ্যটির দাম বাড়ছে। দেশটির মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জে শুক্রবার দশমিক ২ শতাংশ দাম বেড়েছে এলাচের। মে মাসে সরবরাহ চুক্তিতে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০৮ রুপিতে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দু’হাজার টাকা।
গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে মসলার দাম বাড়তে থাকে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এলএমজি মানের এলাচের দাম কেজিতে ১২০ টাকা বেড়ে হয় ৯৮০ টাকা। অন্যান্য এলাচ বিক্রি হয় ১৩শ’ থেকে দু’হাজার টাকায়। এলএমজি মানের এলাচ চলতি বছরের জানুয়ারিতেও বিক্রি হয়েছে ৭৫০ থেকে ৮শ’ টাকায়। এখন সেই এলাচের দাম আবার বেড়ে হয়েছে এক হাজার টাকা। আশঙ্কা করা হচ্ছে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ নাগাদ রমজান শুরু হওয়ার আগে এই মসলার দাম আরো বাড়বে।
মাত্র ক’দিন আগে দেশে ধনিয়ার উৎপাদন মৌসুম শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে পণ্যটির সরবরাহ কমে আসতে শুরু করেছে। ফলে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে মসলাপণ্যটির দাম। দু’সপ্তাহের ব্যবধানে খাতুনগঞ্জে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা জানান, আগাম বৃষ্টিতে মাঠে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় মোকাম থেকে সরবরাহ কমে গেছে এবং এ কারণে ধনিয়ার দাম বেড়েছে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে পাইকারি পর্যায়ে নতুন মৌসুমের ধনিয়া সরবরাহ শুরু হয় ফেব্রুয়ারি থেকে। ওই সময়ে কয়েক দফায় কমে ধনিয়ার মূল্য নেমে আসে প্রতি কেজি ৬০-৬৫ টাকায়। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে বাজারে পণ্যটির সরবরাহ কমতে থাকে। ফলে দাম বাড়তে শুরু করে পণ্যটির। ১৫ দিনের ব্যবধানে ২০ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি কেজি ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের আরএম স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘এবার মৌসুম শেষ হতে না হতেই পণ্যটির সরবরাহ কমে গেছে। আগাম বৃষ্টির কারণে কৃষিপণ্যটির ফলন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে এর সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মোকামের ব্যবসায়ীরা। এতে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে পণ্যটির দাম। এছাড়া ব্যবসায়ীদের মজুদপ্রবণতাও পণ্যটির দরবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাইকারিতে প্রতি কেজি আস্ত ধনিয়া বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায়। হঠাৎ করেই দাম স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় ওই সময়ে ব্যবসায়ীরা পণ্যটি আমদানিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে গরম মসলা আমদানিতে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে ব্যবসায়ীরা পণ্যটি চাহিদামাফিক আমদানিতে ব্যর্থ হন। বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদনের পাশাপাশি মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সীমিত পরিসরে আমদানির মাধ্যমে দেশের বাজারে পণ্যটির চাহিদা পূরণ হয়ে আসছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় এ বছরও শুরুতেই পণ্যটির দাম বাড়তে শুরু করেছে। উৎপাদন বাড়ানো ছাড়াও আমদানি জটিলতা এড়াতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ধনিয়ার বাজার আবারো অস্থির হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৮-৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ধনিয়ার চাষ হয়। এসব জমিতে বছরে উৎপাদিত ধনিয়ার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার টন। দেশের প্রতিটি জেলায় কমবেশি ধনিয়া চাষ হলেও সবচেয়ে বেশি হয় ফরিদপুর ও কুমিল্লায়। বর্তমানে অন্যতম প্রধান মসলাপণ্য হিসেবে দেশব্যাপী ধনিয়ার চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
গত দু’সপ্তাহ ধরে দেশে কমছে দেশি শুকনা মরিচের সরবরাহ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২৫ টাকা দাম বেড়েছে পণ্যটির। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার মৌসুমে বৃষ্টিপাতের কারণে ফলন নষ্ট হয়েছে। ফলে বাজারে পণ্যটির সরবরাহ কম। সরবরাহ ও চাহিদায় অসামঞ্জস্য পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার পাইকারি বাজারে পুরনো (গত মৌসুমের) শুকনা মরিচ বিক্রি হয়েছে ১৩২-১৩৫ টাকা কেজি দরে। যা এক মাস ধরে ১২০-১৩০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছিল। তবে সরবরাহ ভালো থাকায় দাম কিছুটা কমেছে বগুড়ার মরিচের। মৌসুমের শুরুর দিকে খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি বগুড়ার মরিচ বিক্রি হতো ১১৫-১২০ টাকায়। এক মাসের মধ্যে প্রায় ১৫ টাকা কমে বর্তমানে প্রতি কেজি বগুড়ার মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকায়।
রমজান মাস শুরু হতে এখনো দু’সপ্তাহ বাকি। গত কয়েক দিন রসুনের পাইকারি বাজারে কিছুটা স্বস্তি থাকলে হঠাৎ পণ্যটির দর বেড়েছে। চার-পাঁচ দিনের ব্যবধানে বাজারে এক কেজি রসুন ২০ টাকারও বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও পাইকারি বাজারে চায়না রসুনের দাম ছিল কেজি প্রতি ২০০ থেকে ২০৫ টাকা। কিন্তু হঠাৎ করেই কেজি প্রতি রসুন বিক্রি হচ্ছে ২২৫ থেকে ২৩০ টাকার মধ্যে। ভারতীয় রসুন ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। তবে দেশি রসুন আগের মতোই ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
সামগ্রিক বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুন্সী সফিউল হক বলেন, রমজান মাসকে টার্গেট করে কোনো ব্যবসায়ী একতরফাভাবে বা সিন্ডিকেট করে মুনাফা করলে অবশ্যই তা ঠেকাতে হবে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক মনিটরিং টিম মাঠে কাজ করছে।
তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ মসলাই আমদানি নির্ভর। তাই দামের ক্ষেত্রে ততটা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবে চোরাই পথে মসলার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।