নিউজ ডেস্ক:
প্রচারের সব আলো শুষে নেন। সুন্দরী স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে হাত নাড়েন হুডখোলা গাড়ি থেকে। হোয়াইট হাউস থেকে ছড়িয়ে দেন মার্কিন মূল্যবোধ। বেঁচে থাকলে জন এফ কেনেডি আগামীকাল পা দিতেন একশো বছরে।
মজা হয়েছিল সে বারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিতর্কে। ১৯৬০। সে বছরই প্রথম টিভিতে সরাসরি দেখানো হবে প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেট। আমেরিকার ১০ লাখ ঘরে তত দিনে টেলিভিশন পৌঁছে গেছে। কিন্তু আরো বহু ঘরে পৌঁছয়নি। তারা রেডিওতেই শুনলেন রিপাবলিকান প্রার্থী, ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী, ম্যাসাচুসেটসের নবীন সিনেটর জন ফিটজেরাল্ড কেনেডির সেই বিতর্ক।
যারা রেডিওতে শুনলেন, তারা সবাই নিক্সনের সতর্ক, সযত্নে চর্চিত রাজনৈতিক ভাষণ শুনে ধরেই নিলেন, নিক্সনই তর্কে জিতেছেন। আর যারা টিভিতে দেখলেন সেই বিতর্ক, তারা ঘাগু রাজনীতিক, কিছুটা নার্ভাস এবং সতর্ক ভাইস প্রেসিডেন্টের বিপরীতে দেখলেন প্রাণবন্ত এবং সুদর্শন এক মানুষকে, যিনি সরাসরি যেন তাদের সঙ্গেই কথা বললেন। তারা নিশ্চিত হলেন, নিক্সন নয়, কেনেডিই বিতর্কটা জিতেছেন।
অবশ্যই কেনেডি জিতেছিলেন। সেই বিতর্ক এবং সে বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও। কিন্তু গণমাধ্যমের পণ্ডিতরা অবাক হয়েছিলেন, টেলিভিশনের মতো একটা আনকোরা নতুন জনসংযোগ-মাধ্যমকে কেনেডি কী স্বাভাবিক দক্ষতায় ব্যবহার করেছিলেন। যে সব ফটোগ্রাফার আর ক্যামেরাম্যান তারপরেও কেনেডির ছবি তুলেছেন, তারাও একবাক্যে স্বীকার করেছেন, কেনেডি জানতেন কী ভাবে প্রচারের সব আলো নিজের মুখে ফেলতে হয়।
টিভি ক্যামেরা যে সচল, সজীব একটা ব্যাপার, তার সামনে আড়ষ্ট, ভাব-গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে নেই, সেটা কেনেডি সময়ের অনেক আগেই বুঝে ফেলেছিলেন। আর শোম্যান তো তিনি বরাবরই। প্লেন থেকে নেমে প্রেসিডেন্টের লিমুজিনে না উঠে একছুটে চলে যেতেন অপেক্ষারত জনতার সামনে। তাদের সঙ্গে হাত মেলাতেন হাসিমুখে।
আসলে কেনেডি যে বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, সেই ১৯৬০ সাল হলো একটা বদলাতে থাকা সময়ের শুরু। আফ্রিকার একগুচ্ছ ছোট ছোট দেশ ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। কমনওয়েলথ জোট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকা।
আমেরিকায় বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তখন ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। এদিকে মার্কিন পেশাদার বক্সিংয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে কেন্টাকি থেকে আসা ১৮ বছরের এক কালো ছোকরা, ক্যাসিয়াস ক্লে। সেই বছরই রোম অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েট বক্সিংয়ে সোনা জিতেছে সে। ওদিকে ‘প্লেবয়’ খ্যাত হিউ হেফনার শিকাগোয় খুলছেন আমেরিকার প্রথম প্লেবয় ক্লাব।
ওদিকে তখন কেনেডির নির্বাচনী প্রচারের জন্য গান বেঁধে দিচ্ছেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। কেনেডির ভগ্নিপতি, অভিনেতা পিটার লফোর্ড ছিলেন সিনাত্রার বন্ধু। সেই সূত্রেই কেনেডির সঙ্গে সিনাত্রার আলাপ। আমেরিকার নতুন প্রজন্ম তখন উত্তাল সিনাত্রার গানে। ‘সুইঙ্গিং সিক্সটিজ’।
কেনেডিও চমৎকার পা মেলালেন তার সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট হয়েও, যা কিছু সময়ের দাবি, যা কিছু সেই বদলাতে থাকা সময়ের চোখে ঠিক, সে সব কিছুর পাশে দাঁড়ানোর সাহস এবং সততা দেখালেন। যদিও এমন নয় যে সব কিছুর সঙ্গে পুরোপুরি সহমত ছিলেন কেনেডি, কিন্তু সময়ের দাবিটা চিনতে, বুঝতে এবং মেনে নিতে কখনো সঙ্কোচ করেননি। যেমন, আমেরিকার সাদা এবং কালো মানুষের সমান নাগরিক অধিকারের দাবিতে মার্টিন লুথার কিং-এর যে আন্দোলন, তার বেশ কিছু ব্যাপারে কেনেডি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সেই বদলটা যে ঠেকানো যাবে না, আজ না হোক কাল আসবেই, সেটা বোঝার মতো বিচক্ষণতা তাঁর ছিল।
কেনেডি আগ বাড়িয়ে ফোন করলেন কিং-এর স্ত্রী করেটাকে। খোঁজ-খবর নিলেন। যদি লোক-দেখানোও হয়, তবু কেনেডির এই উদ্বেগ ছুঁয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনিদের। কেনেডিও ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। এতে রক্ষণশীল দক্ষিণে কিছু ভোট হারাতে হতে পারে, সেটা জেনেও।
মার্কিন ঐতিহাসিকরা বলেন, শেষ পর্যন্ত রিচার্ড নিক্সনকে অতি সামান্য ব্যবধানে হারিয়ে কেনেডিই যে জিতলেন, তার কারণ ওই উত্তরের কৃষ্ণাঙ্গ ভোট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ব্যবধানের জয়, তবু জয় তো!
হতে পারে ভোট-ব্যাঙ্কের রাজনীতি। আবার হতেও পারে, কেনেডি সত্যিই বিশ্বাস করতেন, সবাই মিলে, সবাইকে নিয়ে দেশ। ইনক্লুসিভ সোসাইটি। তিনি যে এগিয়ে ছিলেন সময়ের থেকেও, সেটা তার নিন্দুকেরাও স্বীকার করেছেন। তাই কেনেডি সমর্থন জানিয়েছেন সমান নাগরিক অধিকারের আন্দোলনকে। পাশে দাঁড়িয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গদের। সমালোচিত হয়েছেন, তবু বরাবর ওদের হয়েই কথা বলেছেন। বিখ্যাত হয়ে আছে তার সেই মন্তব্য-‘একটা কালো বাচ্চা জন্মানোর পর, তার স্কুলে পড়ার সুযোগ একটা সাদা বাচ্চার অর্ধেক। কলেজে যাওয়ার সুযোগ তিন ভাগের এক ভাগ।
জনশ্রুতি, সেই বিরোধের পরিণতিই কেনেডি হত্যা। তদন্তে যদিও প্রমাণ হয়েছিল ঘাতক লি হার্ভে অসওয়াল্ড একা ছিল, তার পাশে বা পিছনে কেউ ছিল না, কিন্তু আমেরিকার এক বড় অংশ সে কথা বিশ্বাস করেনি। মামলা চলাকালে অসওয়াল্ড খুন হয়ে যাওয়ায় সেই সন্দেহ আরো জোরদার হয়। ফলে কেনেডি হত্যা এখনো রহস্যই থেকে গেছে। এখনো তা নিয়ে বই লেখা হয়, সিনেমা তৈরি হয়। আর বহু লাখ বার দেখা হয় সেই ভিডিয়ো ফুটেজ।
মাথায় গুলি লাগার ঠিক আগের মুহূর্তে, হুডখোলা লিমুজিনে বসে রাস্তার দু’পাশে ঝাঁক বেঁধে থাকা মানুষের দিকে হাসিমুখে হাত নাড়ছেন কেনেডি। পাশে বসা হাসিখুশি ‘ফার্স্ট লেডি’ জ্যাকলিন। ইতিহাস বলে, অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন ছাড়া আর কোনো প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে এত কাঁদেনি আমেরিকা!
এর পাশাপাশি ছিল কেনেডির ব্যক্তি জীবনের তুলকালাম নষ্টামি এবং তার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। ঘরে জ্যাকলিনের মতো সুন্দরী, লক্ষ্মীমন্ত বউ, সারাদেশ তাকে ভালবাসে, অথচ কেনেডি ভালোবেসে বেড়ান বিশ্ব সংসারের বাকি মেয়েদের। বন্ধুরা কবুল করেছেন, সুন্দরী দেখলে কেনেডি মাথা ঠিক রাখতে পারতেন না। আর হোয়াইট হাউস’র ‘ওভাল অফিস’-এর পবিত্রতা নষ্ট করার দুর্নাম জুটেছিল কিনা বেচারি বিল ক্লিন্টনের! তখনো কিন্তু মার্কিন আমজনতা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, কোথায় মেরিলিন মনরো, আর কোথায় মনিকা লিউইনস্কি!
আরো মজার কথা, মনরো-কেনেডির এই প্রেম রীতিমত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে উদযাপিত হয়েছে মার্কিন গণজীবনে। ১৯ মে ১৯৬২। কেনেডির আসল জন্মদিনের ১০ দিন আগেই উৎসব হবে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে। ১৫ হাজার অতিথির তালিকায় তাবড় রাজনীতিক ও হলিউড সেলেব-দের ছড়াছড়ি।