চুয়াডাঙ্গায় মাদকব্যবসা নিয়ে বিরোধ : প্রতিপক্ষকে কাবু করতে অভিনব পন্থা অবলম্বন
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের বিচক্ষণতায় প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন : গুজব ছড়ানোয় চার নারী আটক
নিউজ ডেস্ক:চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ফার্মপাড়াস্থ রেলবস্তিতে মাদক ও অবৈধ ব্যবসা চালাতে সাজানো হয় এক অভিনব পন্থার নাটক এবং ছড়ানো হয় গুজব। নিজ পিতা কর্তৃক মেয়েকে ধর্ষণের অপবাদ দিয়ে ইলিয়াছ নামের এক ব্যক্তিকে গণধোলাই দেয় সুবিধাবাদীরা। এমন এক ঘটনার তদন্ত করতে বেরিয়ে আসলো থলের বিড়াল। এদিকে, গুজব ছড়ানোর অভিযোগে চার নারীকে আটক করেছে সদর থানা পুলিশ। ঘটনার তদন্তের স্বার্থে আটককৃতদের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ। গতকাল রাত আনুমানিক ৩টার দিকে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করা হয়। ঘটনার শুরুতে পিতা কর্তৃক কন্যা ধর্ষণের বিষয়টি উঠে আসলেও চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার কানাই লাল সরকারের বিচক্ষণতায় বেরিয়ে আসে আসল কাহিনী। সেই রাত ১০টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত খুব বিচক্ষণতার সাথে একটানা তদন্ত চালিয়ে বের করে আনেন ঘটনার মূল রহস্য। এ ঘটনায় চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ হিসেবে দায়িত্বে থাকা কানাই লাল সরকারের প্রশংসা করেছেন সাংবাদিকমহলসহ চুয়াডাঙ্গাবাসী।
পুলিশ জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ফার্মপাড়াস্থ রেলবস্তি এলাকায় ইলিয়াছ নামের এক ব্যক্তিকে নিজ কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে গণধোলাই দেয় উত্তেজিত জনতা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ গণধোলাইয়ের শিকার ইলিয়াছকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় নিয়ে আসে। সেই সাথে ইলিয়াছের মেয়ে ও স্ত্রীকেও থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। এরপর শুরু হয় পুলিশ জেরা। ঘটনার প্রথম দিকে ভিকটিমসহ ইলিয়াছের স্ত্রী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট নিজ স্বামীর সাথে তার মেয়ের অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে জানায়। পুলিশও সেই অভিযোগের ভিত্তিতে মামলার দিকে এগোতে থাকে। এমনকি সদর থানার ওসি সাংবাদিকদের কাছে বিফ্রিংও দেন। কিন্তু হঠাৎ ঘটনার মোড় ৯০ ডিগ্রি এ্যাঙ্গেলে ঘুড়িয়ে দেন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার কানাই লাল সরকার। তিনি সদর থানায় এসে ঘটনার ধর্ষণ অভিযোগের বিষয়টি মনোযোগ সহকারে শোনেন। ঘটনা বিস্তারিত শুনার পর বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হয় ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের। এসময় পুলিশ সদর থানার ওসিকে নিয়ে নিজেই নেমে পড়েন প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের তদন্তে। এরপর যা বেরিয়ে আসে, তা শুনে সবাই হতবাক!
জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার রেলবস্তিতে ছোট জনি, বড় জনি, মন্টু, রবিউল মিলে মাদক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে এবং অত্র এলাকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা বিএডিসি ফার্মে অবৈধ সম্পর্কের অপবাদ দিয়ে বিভিন্ন সময় ঘুরতে আসা যুবক-যুবতী ও ছেলে-মেয়েদের ধরে আনতো এই সিন্ডিকেট। আর এই সব ছেলে-মেয়েদের ইলিয়াছের বাড়ীতে আটকিয়ে রেখে নগদ টাকাসহ বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে ছেড়ে দিত এই সিন্ডিকেট। এভাবে চলছিলো এই সিন্ডিকেটের যতসব অবৈধ কাজ। হঠাৎ এই সিন্ডিকেটের অপর ৪ সদস্যের সাথে মাদকব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ বাধে ইলিয়াছের। এরপর থেকে জনিরা ইলিয়াছকে ফাঁসাতে এবং ইলিয়াছের মাদকব্যবসা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিতে ফাঁদ পাতে। ফাঁদ অনুযায়ী বেশ কয়েকদিন আগে বড় জনি তার ভাগিনা বর্ষা নামের একটি কিশোরী মেয়েকে দিয়ে এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, ইলিয়াছ একজন মাতাল, সে নেশা করে তার নিজের মেয়েকে নিয়মিতভাবে ধর্ষণ করে। যেটা কিনা কিশোরী বর্ষা নিজ চোখে দেখেছে। বিষয়টি দু’একদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো রেলবস্তি এলাকায়। এর জের ধরে গতকাল আবারও ইলিয়াছ তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে এমন গুজব রটায় ওই এলাকার ৪/৫ জন নারী। এই গুজবে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এ ঘটনার সুযোগ নিয়ে বড় জনি ইলিয়াছের বাড়ীতে তাকে এলাকার মোড়ল-মাত্ববররা ডাকছে বলে ফার্মপাড়ার কদমতলা মোড়ে নিয়ে আসে। এরপর ছোট জনি, মন্টু, রবিউলসহ স্থানীয় কয়েকজন নিজ মেয়েকে ধর্ষণের অপবাদ দিয়ে ইলিয়াছকে তার মারতে থাকে। এসময় উপস্থিত এলাকাবাসী প্রকৃত ঘটনা না জেনেই ইলিয়াছকে গণধোলাই দিয়ে সদর থানা পুলিশে সোপর্দ করে। পরে পুলিশ প্রকৃত ঘটনা উন্মোচনে ইলিয়াছসহ তার মেয়ে ও স্ত্রীকে থানায় নিয়ে আসে। এরপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে প্রকৃত ঘটনা।
চিহিৃত মাদকব্যবসায়ী ইলিয়াছের মেয়ে বলে তার বাবা তাকে ধর্ষণ করেছে বলে জানায়। এসময় ইলিয়াছের স্ত্রীও মেয়ের সাথে তালমিলিয়ে জানায়, তার মেয়েকে তার স্বামী ধর্ষণ করেছে। কিন্তু পরে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসলে ইলিয়াছের মেয়ে জানান- সে যা বলেছে সব মিথ্যা। তার বাবা তাকে ধর্ষণ করেনি। জনিরা তাকে হত্যাসহ বিভিন্ন হুমকী দিয়ে এই অপবাদ দিতে বলেছে, সে ভয়ে বাবার বিরুদ্ধে এই অপবাদ দিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসলে ইলিয়াছের স্ত্রীও জানান তাকে জনিরা তাকে হত্যাসহ বিভিন্ন হুমকী দিয়ে এই অপবাদ দিতে বলেছে, সে ভয়ে তার স্বামীর বিরুদ্ধে এই অপবাদ দিয়েছে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জিহাদ খান বলেন, ধর্ষণের ঘটনাটি ভিত্তিহীন। মাদকব্যবসাকে কেন্দ্র করে নিজ মেয়েকে ধর্ষণের অপবাদ দিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছে ইলিয়াছ। এ ঘটনার গুজব ছড়ানোর অভিযোগে চার নারীকে আটক করা হয়েছে। প্রকৃত আসামীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে ইলিয়াছ নিজেই একজন মাদককারবারি। আমরা পুঙ্খানুপঙ্খুভাবে বিষয়টি তদন্ত করেছি এবং প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করেছি।
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার কানাই লাল সরকার বলেন, মাদকব্যবসা চালাতেই ধর্ষণের অপবাদ দিয়ে ইলিয়াছকে গণধোলাই দেয় এলাকার কিছু চিহ্নিত মাদকব্যবসায়ী। এই নাটকের মূল হোতাদেরকে চিহ্নিত করেছি। অভিযুক্তদেরকে আটকের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।