রফিকুল ইসলাম রফিক,নান্দাইল (ময়মনসিংহ) সংবাদদাতাঃ
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মুশুলী ইউনিয়নের কালীগঞ্জ ব্রীজ সংলগ্ন স্থান ও চন্ডীপাশা ইউনিয়নের বারুইগ্রাম মাদ্রাসা সংলগ্ন দুটি বধ্যভূমি আজও অরক্ষিত, নির্মাণ করা হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ব। ১৯৭১সনে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দুটি স্থানেই শত শত মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও রাজাকার। ট্রেনে মুক্তিকামী ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে পেছন হাত বেঁধে রেলসেতুতে হাঁটতে বলা হতো। মাঝামাঝি স্থানে যেতেই গুলি করা হতো তাদের। গুলিবিদ্ধ দেহ সেতুর নিচে প্রবাহমান নদীতে ভেসে যেত। ওই সময় মানুষের বাঁচার চিৎকার মিলিয়ে যেত পাকিস্তানি হানাদারদের গুলির শব্দে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসংখ্য মানুষকে নৃশংসতা চালিয়ে হত্যা করা হয় ময়মনসিংহের নান্দাইলের কালীগঞ্জ-শুভখিলা রেলসেতুতে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও নৃশংসতা চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যার স্থানটি চিহ্নিত করা হয়নি এখনও। স্থাপিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ব।
নান্দাইল উপজেলার মুশুলী ইউনিয়নের শুভখিলা গ্রাম। নরসুন্দা নদীর কোলঘেঁষা এ গ্রামের ভেতর দিয়ে ভৈরব-ময়মনসিংহ রেললাইন রয়েছে। শুভখিলা গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে নরসুন্দা নদীর ওপর একটি রেলসেতু রয়েছে। সেতুটি কালীগঞ্জ রেলসেতু নামেই পরিচিত। কিশোরগঞ্জ ও নান্দাইল উপজেলা-লাগোয়া এ সেতুতেই চলে স্বাধীনতাযুদ্ধের বর্বরতা। স্থানটিতে যাওয়ার জন্য ভালো কোনো রাস্তা নেই। নরসুন্দা নদীর কোলঘেঁষে মেঠোপথ ধরে যেতে হয় স্থানীয়ভাবে ‘কালীগঞ্জ বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত স্থানটিতে।
১৯৭১ সালের মার্চে দেশে যুদ্ধ শুরু হলেও এপ্রিলের প্রথমদিকে গ্রামে ঢুকতে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে জামালপুর, ময়মনসিংহ, গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, সোহাগী, আঠারবাড়ি, নান্দাইল, ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, সরারচর, মানিকখালী, গচিহাটা, কিশোরগঞ্জ, নীলগঞ্জ স্টেশন থেকে নিরীহ মানুষকে এনে হত্যাযজ্ঞ চালানো হতো। মূলত ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে কালীগঞ্জ রেলসেতু এলাকায় তাঁবুতে রেখে নির্যাতন শেষে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হতো।
নান্দাইল উপজেলার চন্ডীপাশা ইউনিয়নের খামারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার, পলীচিকিৎসক খগেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ও ভূপেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার। তারা ছিলেন তিন ভাই। যুদ্ধের সময় পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে রেখে বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন তারা। কিন্তু বাড়ির কয়েকজন কাজের লোক আঁতাত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর তিন ভাইকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা।
নান্দাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার মাজহারুল হক ফকির বলেন, রেলসেতুটিতে যুদ্ধকালীন পুরো সময় ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ট্রেনে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এনে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। হাজার হাজার মানুষের হত্যাযজ্ঞ চলে সেতুটিতে। তা ছাড়া বারইগ্রাম মাদ্রাসার কাছের ইটভাটায় শতাধিক মানুষকে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়। দুটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা অনুমোদন না হওয়ায় বধ্যভূমিগুলোতে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা যায়নি। নান্দাইল আসনের সংসদ সদস্য মো আনোয়ারুল আবেদীন খাঁন তুহিন অরক্ষিত দুটি বধ্যভূমি স্থান পরিদর্শন করে উপস্থিত জনতার সামনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার ঘোষণা দেওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটছে না।