চুয়াডাঙ্গার মা ক্লিনিকে আনাড়ি ডাক্তার দিয়ে দুদফা অস্ত্রপচার : স্যালাইন সেটের
নিউজ ডেস্ক:চুয়াডাঙ্গার একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে অস্ত্রপচারের পর এক প্রসূতির পেট থেকে স্যালাইন সেটের নল, গজ-ব্যান্ডেজ বের হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ওই প্রসূতির নাম পলি খাতুন (২০)। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ঠাকুরপুর মসজিদপাড়ার বিপুল আলীর স্ত্রী। গতকাল শুক্রবার সকালে তাঁকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। প্রসূতির পরিবারের অভিযোগ, ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ দুজন আনাড়ি ডাক্তার দিয়ে দুই দফায় পলিকে অস্ত্রপচার করলেও তিনি সুস্থ হননি। বরং গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যদিও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ও অস্ত্রপচারকারী চিকিৎসক গজ-ব্যান্ডেজ উদ্ধারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, গজ-ব্যান্ডেজ বের হওয়ার অভিযোগটি হাস্যকর। তবে অভিযোগটি অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যর তদন্ত কমিটি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম।
প্রসূতি পলি খাতুনের স্বামী বিপুল আলী জানান, জীবনে প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার আনন্দে বিভোর ছিলেন তিনি। সন্তান প্রসবের বেদনা উঠলে স্ত্রী পলিকে ভর্তি করানো হয় চুয়াডাঙ্গা শহরের হাসপাতাল এলাকার মা নামের এক বেসরকারি ক্লিনিকে। গত ২০ মে ভর্তির পর বিকেলে ডা. লিফা নারছিস চৈতী অস্ত্রপচার করেন পলিকে। অস্ত্রপচারের মাধ্যমে পলি খাতুন ফুটফুটে এক মেয়ে সন্তান প্রসব করেন। সন্তান প্রসবের চার দিন পর ওই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠান পলিকে।
প্রসূতির মা আসমা খাতুন জানান, ক্লিনিক থেকে বাড়িতে যাওয়ার কয়েকদিন পর পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হয় পলির। পেট ফুলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন পলি। তাঁকে ফের ওই ক্লিনিকে নিয়ে গেলে আবারও অস্ত্রপচার করা হয়। অস্ত্রপচার করেন ডা. এহসানুল হক তন্ময়।
প্রসূতি পলি খাতুনের দাবি, ‘২য় দফায় অস্ত্রপচারের সময় আমার পেট থেকে বের হয় গজ-ব্যান্ডেজ ও সুতা। এ সময় আমি চিকিৎসকের কাছে বিষয়টি নিশ্চিত হতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে জানান, বাচ্চার শরীরে ময়লা ছিল একটু। পরিষ্কার করে সেলাই করে দিয়েছি, এখন আর কোনো সমস্যা নেই।’
পলির বাবা জেদ আলী শেখের অভিযোগ, ‘আমার মেয়ে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার শিকার। মা ক্লিনিক থেকে ২য় দফায় অস্ত্রপচারের পর বাড়িতে যাওয়ার কয়েকদিনের মাথায় আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে আমার মেয়ে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে শুক্রবার সকালে মা ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়। এ সময় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা বাবদ আবার চার হাজার টাকা দাবি করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় ক্লিনিক থেকে। আমরা তখন মেয়েকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হই।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. এহসানুল হক তন্ময় বলেন, সেলাইটাকে মজবুত করার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক ডাক্তারি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে, যাকে টেনশন ক্লোজার বলে। এ পদ্ধতিতে সেলাইয়ের সময় চামড়ার ওপর প্রতিটি সেলাইয়ের সঙ্গে একটি করে এক ইঞ্চি পরিমাপের স্যালাইন সেটের নল ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে সেলাই কাটার সময় এ নলগুলো নিজে থেকেই বেরিয়ে আসে। তবে কোনো কারণে হয়তো পলি খাতুনের সেলাই কাটার সময় একটি নল থেকে গেছে।’
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সার্জারি কনসালটেন্ট ওয়ালিউর রহমান নয়ন বলেন, ‘পেটে গজ-ব্যান্ডেজ থাকার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে রোগীর পেটের সেলাইয়ের স্থানে ইনফেকশন হয়েছে। ক্ষতের মাত্রাটি একটু বেশি। তা ছাড়া রোগীর শরীরে রক্ত কম। আমরা সাধ্যমত চিকিৎসা দিচ্ছি। রোগীর সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে।’
এ ব্যাপারে মা ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমানের দাবি, ‘কোনো ভুল চিকিৎসার ঘটনা ঘটেনি। অস্ত্রপচার সফল ছিল। রোগীর অ্যাজমা সমস্যা ছিল, তাই অতিরিক্ত হাঁচি ও কাশিতে রোগীর পেটের সেলাই কেটে গিয়েছিল। আমরা আবারও অস্ত্রপচার করে তা ঠিক করে দিয়েছি।’
অস্ত্রপচারকারী চিকিৎসক ডা. লিফা নারছিস চৈতীও এমনটিই দাবি করে জানান, রোগীর পেটে গজ-ব্যান্ডেজ থাকার বিষয়টি মিথ্যা ও হাস্যকর।
সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম বলেন, অভিযোগটি গুরুতর। বিষয়টি অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে গঠন করা হবে তিন সদস্যর তদন্ত কমিটি। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক সূত্র নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত এক বছরে মা ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা অন্তত ছয়জন রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যা উদ্বেগজনক। ক্লিনিকটির রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ গত বছরে শেষ হলেও তা নবায়ন করা হয়নি। ১০ শয্যার অনুমোদন থাকলেও ক্লিনিকটিতে শয্যা রয়েছে ২৪টি। এত কিছুর পরও ক্লিনিকটি কীভাবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।