ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, বগুড়া, রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলে গুটি স্বর্ণা ধান বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৭৬০ টাকায়। গত মৌসুমে প্রতি মণ গুটি স্বর্ণা বিক্রি হয় ৪৮০ থেকে ৬৫০ টাকায়। চিকন চালের ধান বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ৯২০ টাকায়। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের ভাদুয়া-শ্রীপুর গ্রামের কৃষক আবু সামা জানান, গত বুধবার পাইজাম জাতের ধান ৯০৫ টাকা মণে
বিক্রি করেছেন। কয়েক বছর ধানের দাম নিয়ে তিনি হতাশ হলেও এবার দারুণ খুশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিইএ) সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৫৫ হাজার টন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত অর্থবছরে ৫৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩১ লাখ ৯০ হাজার টন আমন ধান উৎপাদন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান সমকালকে বলেন, মাঠে পুরোদমে আমন ধান কাটা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আবাদের অর্ধেক এলাকার ধান কাটা শেষ হয়েছে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে। ভালো দাম পাওয়ায় এবার কৃষকরা দারুণ খুশি।
উত্তরের চার জেলা বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জেও ভালো দাম পাওয়ায় খুশি কৃষক। গত বছরের তুলনায় এবার মৌসুমের শুরুতেই জাতভেতে ধান মণপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি দরে কেনা-বেচা হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, এবার চালের বাজার চড়া থাকায় ধানের দাম বেড়েছে। পাশাপাশি ফলনও ভালো হওয়ায় গত বছরের মতো এবার লোকসানের আশঙ্কা নেই। যে কারণে মৌসুমের শুরুইে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়েছে কৃষক-কৃষাণীর চোখে-মুখে। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ওই চার জেলায় মোট আবাদ করা আমনের অন্তত ৬৫ শতাংশ কাটা হয়ে গেছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চিকন জাতের ধান যেমন- ‘বিনা-৭’, ‘বি আর-৪৯’, ‘রণজিত’, ‘স্বর্ণা’ ‘পাইজাম’ ও ‘কাটারিভোগ’ ধানই আগে পেকেছে। আর ‘ব্রি-৩৩’, ‘ব্রি-৩৯’, ‘ব্রি-৫৬’সহ মোটা জাতের ধানগুলো এখন পাকতে শুরু করেছে।
বগুড়ার কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, হাইব্রিড, উচ্চ ফলনশীল এবং স্থানীয়_ এই তিন ধরনের ধানে এবার হেক্টরপ্রতি গড় ফলন এসেছে ৩ দশমিক ১৪ টন। বগুড়ায় বরাবরের মতো এবারও নন্দীগ্রাম ও শাজাহানপুরে বেশ আগেই ধান কাটা শুরু হয়েছে। নন্দীগ্রামের পেংহাজারকি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, মাঠের অর্ধেকেরও বেশি জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা থেকে আসা অনেক শ্রমিক ধান কাটার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ওই গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান জানান, এবার মৌসুমের শুরুতে কিছুটা খরা ছিল, তবে পরে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। তার মতে প্রথম দিকে খরা থাকার কারণে ধান গাছে পোকা-মাকড় আক্রমণ করতে পারেনি। পরে যখন গামর (গাছে ধান জন্ম নেয়) আসে তখন বৃষ্টি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ফলন ভালো হয়েছে।
আবু বকর নামে এক কৃষক বলেন, গত বছর ধান কাটার মৌসুমে স্বর্ণা জাতের ধানের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকা মণ। এবার একই ধান ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে কেনাবেচা হচ্ছে। ‘বিনা-৭’ ও ‘রণজিত’ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকায়। দাম ভালো পাওয়ায় খুশি মিজানুর রহমান বলেন, এবার ১০ বিঘা জমিতে দিনাজপুরের বিখ্যাত ‘কাটারিভোগ’ ধানের আবাদ করেছিলাম। প্রতি বিঘায় গড়ে ২০ মণ করে ফলন পেয়েছি। প্রতিমণের দামও ৮৫০ টাকার উপরে। সামনের দিনে দাম আরও বাড়বে বলে আশা করছি। এতে লাভের পরিমাণও বাড়বে। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বীরগ্রামের কৃষক আবদুল কুদ্দুস জানান, তিনি তার ৫ বিঘা জমির মধ্যে ৩ বিঘায় ‘স্বর্ণা’ এবং বাকি ২ বিঘায় ‘বিনা-৭’ জাতের ধান আবাদ করেছিলেন। প্রতি বিঘায় গড়ে ১৯ মণ করে ফলন পেয়েছেন। পাইকাররা প্রতি মণ ‘স্বর্ণা’ জাতের ধানের দাম হাঁকাচ্ছেন ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা আর ‘বিনা-৭’ কেনাবেচা হচ্ছে ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকায়। তার মতে এবার চালের দাম চড়া হওয়ার কারণেই ধানের দামও বাড়তির দিকে। আমন আবাদে কৃষকদের ভালো লাভ থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, এক বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করতে অঞ্চল ভেদে ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। এখন ধানের যে দাম যাচ্ছে তাতে সব খরচ বাদ দিয়েও একজন কৃষকের ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ থাকবে।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার কৃষক আনিসুল হক জানান, গত বছরের তুলনায় এবার রণজিত ও লাল পাইজাম জাতের ধান মণপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি দামে বেচাকেনা হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার সকালে রণজিত বিক্রি হয়েছে ৭৪০ টাকা মণ দরে। গত বছর এই জাতের ধান কেনাবেচা হয়েছে ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকায়। একইভাবে গত বছরের ৮৫০ টাকার লাল পাইজাম ধান এবার বিক্রি হচ্ছে ৯৩০ থেকে ৯৫০ টাকা মণ দরে। উপজেলার ধাপসুলতানগঞ্জ হাটের ধান ব্যবসায়ী আবুল কাশেম জানান, মূলত অটো রাইস মিল মালিকরাই বেশি ধান কিনছেন। বগুড়া কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক হযরত আলী জানান, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে।
অনুকূল আবহাওয়া থাকায় রাজশাহীতেও এবার রোপা আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ভালো ফলনের সঙ্গে এবার দামও মিলছে ভালো। রাজশাহীর অধিকাংশ চাষির ধান কাটা হয়ে গেছে। চাষিরা জমিতে রেখেই ধান শুকিয়ে নিচ্ছেন। এরপর তারা ধান মাড়াই করে ঘরে তুলছেন। এ কাজে চাষিদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার শ্রমিকরা। পবা উপজেলার দুয়ারী গ্রামের কৃষক দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, গত বছর ৫০০ টাকা মণ দরে ধান কেনার লোক ছিল না। এ বছর মোটা ধানও বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা মণ। সরু ধান ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
পবা উপজেলার মাঝিগ্রাম এলাকার চাষি আবদুর রশিদ জানান, ৪৯ জাতের ধান ৯০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। ভালো দাম থাকায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘এবার রোপা আমন চাষের মৌসুমটা খুবই অনুকূলে ছিল। কিছু দিন পরপর পরিমাণ মতো বৃষ্টি হয়েছে। তাই সেচের প্রয়োজন হয়নি। আকাশ মেঘলা ছিল না বলে রোগবালাই কম হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে ২০ থেকে ২২ মণ হারে ধান হয়েছে।