অবৈধ যান বন্ধে পুলিশের কঠোর অবস্থান, প্রতিবাদে ইজিবাইক ধর্মঘট
নিউজ ডেস্ক:চুয়াডাঙ্গার প্রধান সড়কগুলো থেকে অযান্ত্রিক যানবাহন উচ্ছেদে একদিকে পুলিশের কঠোর অবস্থান, অন্যদিকে প্রতিবাদে জেলার চারটি উপজেলাতে একযোগে ইজিবাইক মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘটে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আঞ্চলিক সড়ক ও মহাসড়কে গতকাল শনিবারই ছিল অবৈধ যান চলাচলের শেষ দিন। শেষ দিনে প্রতিবাদে হঠাৎ করেই ধর্মঘট ডাকে ইজিবাইক মালিক-শ্রমিক। ফলে কার্যত অযান্ত্রিক যান ও ইজিবাইক শূন্য হয়ে পড়ে সড়কগুলো। এ সময় শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে অবস্থান নিয়ে পিকেটিং করতে দেখা যায় ধর্মঘটি ইজিবাইক শ্রমিকদের একাংশকে। ভাঙচুর করা হয় বেশ কয়েকটি ইজিবাইক। মারপিটের শিকার হন বেশ ক’জন ইজিবাইক চালক।
এদিকে, আকস্মিক ধর্মঘটের কারণে দিনভর অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পর রাতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে মাইকিং করা হয়েছে শহরে। গতকাল শনিবার রাতে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বাংলাদেশ অটোবাইক শ্রমিক কল্যাণ সোসাইটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের জরুরি বৈঠক শেষে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সন্ধ্যা সাতটায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে শ্রমিক-মালিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন। দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পর সভায় শ্রমিক নেতারা সিদ্ধান্ত নেন ধর্মঘট প্রত্যাহারের। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও চুয়াডাঙ্গা জজ কোর্টের পিপি অ্যাড. বেলাল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক শওকত আলী প্রমুখ।
ধর্মঘট প্রত্যাহার প্রসঙ্গে রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন বলেন, ‘ধর্মঘটে যাত্রী সাধারণের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ প্রত্যক্ষ করেছি। যাত্রীদের দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শ্রমিক-মালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ধর্মঘট নিরসন করেছি।’
অন্যদিকে, ইজিবাইক শ্রমিকদের আকস্মিক ধর্মঘটে নির্ধারিত গন্তব্যে যেতে গিয়ে বাহন না পেয়ে বিপাকে পড়তে হয় শতশত যাত্রী সাধারণকে। বাসের ছাদের ওপরে ওভারলোডে বসে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে হাজারো মানুষকে। খালি ট্রাকেও উঠেছেন বহু যাত্রী গন্তব্যে যেতে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে দেখা গেছে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের। তারা পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে গিয়ে যানবাহন না পেয়ে পড়েন চরম দুর্ভোগে। অনেককে পায়ে হেঁটে আসতে দেখা গেছে পরীক্ষা কেন্দ্রে। নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রে ঢুকতে পারেনি অনেক পরিক্ষার্থী। যানবাহন সংকটের এ সুযোগে কিছু রিকশা চালকও হাকিয়ে বসেন কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। বেশ ক’জন মোটরসাইকেল চালককেও এই সুযোগ বুঝে শহরে ভাড়া মারতে দেখা গেছে। আবার ভালাইপুর মোড়ে ইজিবাইক আসতে না পারায় মানবিক বিবেচনায় চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স সহযোগিতা করেছেন এসএসসি পরিক্ষার্থীদের। তাঁদের দুটি বাসযোগে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছেন।
পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে ইজিবাইক বন্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এসএসসি পরীক্ষার্থী তন্ময় আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘কোন সিস্টেমে যাচ্ছি আমরা। মন চাইল আর হঠাৎ করেই ধর্মঘট ডেকে বসলাম। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।’
পরীক্ষার্থী তানজিলা মৌসুমী বলেন, ‘বাড়ি থেকে বের হয়ে শুনছি অটোবাইক ধর্মঘট। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে প্রায় আধা ঘণ্টা আগে। অনেক কষ্টে পরীক্ষার হলে পৌঁছেছি। চার জায়গায় অটো আটকানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত টাউন মাঠের সামনে থেকে হেঁটে কেন্দ্র ভি জে স্কুলে আসতে হয়েছে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক কামরান আলী বলেন, ‘প্রতিদিন একাই পরীক্ষা দিতে আসে আমার ছেলে। আজ হঠাৎ অটো বন্ধ থাকবে জেনে আমি নিজে সঙ্গে এসেছি। না আসলে বোধহয় ওর পরীক্ষা দেওয়া হতো না। ধর্মঘটিরা এসএসসি পরীক্ষার কথাও শুনতে চাই না। বেশ কয়েক জায়গায় অটো বাঁধা দেওয়া হয়েছে।’
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের ছাত্র আবির হোসেন বলেন, ‘কলেজে আসার সময় বাসের ছাদে চড়ে এসেছি। ছাদেও এত বেশি পরিমাণে যাত্রী যে বসার জায়গা নেই। ওভার লোডের ওপর আবার লোড। খুব কষ্ট করে আসতে হয়েছে।’
আলমডাঙ্গা উপজেলার ভাংবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহমান জানান, ‘জরুরি কাজে সকালে জেলা শহরে আসছিলাম। ভালাইপুর মোড়ে আসতেই কিছু উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক আমাদের গাড়িটি আটকে ভাঙচুর করে। মারধর করে চালককে। উপান্তর না পেয়ে পায়ে হেঁটেই বাড়িতে ফিরতে হয়েছে।’ গতকাল শনিবার দিনভর চুয়াডাঙ্গা শহরের পাশাপাশি উপজেলা শহরেগুলোতেও দেখা গেছে কিছু উচ্ছৃঙ্খল অটো শ্রমিকরা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে পিকেটিং করছে। প্রকাশ্যে ভাঙচুর করছে অটোবাইক।
চুয়াডাঙ্গা জেলা অটোবাইক শ্রমিক কল্যাণ সোসাইটির সভাপতি মুনতাজুর রহমান জানান, ‘চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলাতে প্রায় ২০ হাজার ইজিবাইক আছে। অনেক শিক্ষিত বেকার চাকরি না পেয়ে স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে সংসার পরিচালনা করছেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ইজিবাইককে অবৈধ যান ঘোষণা করে সড়ক থেকে উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন। এর প্রতিবাদে আমরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিলাম।’
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শরীফুল ইসলাম সাজু বলেন, ‘আমরা আমাদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম। সাবেক মেয়র টোটন জোয়ার্দ্দারের মাধ্যমে এসপি মহোদয়ের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, আগামী আইনশৃংঙ্খলা মিটিংয়ে ডিসি এবং চার ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চার উপজেলার জন্য আলাদা আলাদা রং করে চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে।’
চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কানাই লাল সরকার বলেন, ‘উচ্চআদালতের নির্দেশনা মোতাবেক জেলার প্রধান সড়কগুলোতে আমরা কোনোভাবেই অযান্ত্রিক যান চলাচল করতে দিব না। এ বিষয়ে আমাদের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে ফিডার সড়কগুলো ও গ্রাম্য সড়কগুলোতে চলাচলে কোনো বিধি নিষেধ নেই।’
প্রসঙ্গত, ১০ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গার পুলিশ প্রশাসন চার দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে চুয়াডাঙ্গার সড়কগুলো থেকে অযান্ত্রিক সব ধরণের যান উচ্ছেদের ঘোষণা দেয়। জেলার পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম নিজেই রাস্তায় নেমে অযান্ত্রিক যানচলাচলে কঠোর নির্দেশনা দেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি সেই আল্টিমেটাম শেষ হয়েছে। শনিবার নির্ধারিত দিনে জেলার সব রুটে পুলিশ অবস্থান নিয়ে অযান্ত্রিক যান আটকে অভিযান শুরু করেছে। এরই প্রতিবাদে ইজিবাইক মালিক শ্রমিকেরা লাগাতার ধর্মঘট পালন করেন।