চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র
নিউজ ডেস্ক:চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সরব দালাল চক্র। এ দালাল চক্রের কবলে পড়ে সহজ-সরল নিরীহ মানুষেরা হচ্ছেন প্রতারিত। দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ রোগীরা। কখনো কখনো রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠে এ দালাল চক্র। শহরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি ক্লিনিকের দালালেরাও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করে থাকেন। এসব দালাল চক্র ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের পরীক্ষা করাতে নিয়ে যেতে শুরু করে টানাটানি।
জানা গেছে, গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসা সাধারণ লোকজনকে তাৎক্ষণিক ভর্তি করানো থেকে ওয়ার্ডে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে সাহায্য করেন দালালেরা। পরে সুযোগ বুঝে রোগীদের বিপাকে ফেলেন তাঁরা।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ২১৮ নম্বর কক্ষে রোগী দেখেন হাসপাতালের জুনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ডা. আবুল হোসেন। দেখা গেছে, এ কক্ষই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের প্রধান লক্ষ্য। এখানে দালালেরা ৩ ধাপে রোগীদের নিয়ে যান নিজেদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এ ৩ ধাপে কাজ করেন চারজন সদস্য। এ তিন ধাপ-বিশিষ্ট দালালেরা শুধু নিজেদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই নয়, আশপাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও রোগী সরবরাহ করে থাকেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২১৮ নম্বর কক্ষকে ঘিরে কাজ করেন সিরাজ, লালু, তুষার ও সাইফুল নামের চারজনের একটি দালাল চক্র। তাঁদের গতিবিধি লক্ষ করে জানা যায়, তাঁরা কাজ করেন হাসপাতাল সড়কের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হয়ে। প্রথমে কক্ষের দরজায় রোগী নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন লালু। রোগীদের কক্ষের ভেতরে-বাহিরে নেওয়ার দায়িত্বে থাকেন তিনি। এরপর কক্ষের ভেতরে থাকেন সিরাজ। রোগীদের ভালো ও কম খরচে পরীক্ষা করানোর কথা বলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেওয়ার প্রধান কাজটা তিনিই করেন। চিকিৎসক সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর ব্যবস্থাপত্রে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষ লিখে থাকেন। এ সময় রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে নজর রাখেন সিরাজ। ব্যবস্থাপত্র হাতে পেলেই ফুঁসলিয়ে তিনি রোগীকে কক্ষের বাইরে বের করে তুলে দেন তুষারের হাতে। তুষার রোগীকে নিয়ে যান হাসপাতালের গোল চত্বরে। সেখানে অপেক্ষা করেন সাইফুল। এরপর সাইফুল রোগী ও তাঁর স্বজনকে নিয়ে চলে যান ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
এদিকে, ক্লিনিকের দালাল চক্ররাও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের আরও উন্নত সেবার লোভ দেখিয়ে ভাগিয়ে নিতে তৎপর থাকে। হাসপাতালে দিন দিন দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। দালাল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ সিন্ডিকেটের কাছে অনেকটা অসহায়। মাঝেমধ্যে দালাল চক্রের সদস্যদের আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে তুলে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর কিছু দিন দালালেরা হাসপাতাল ছেড়ে গেলেও পরে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন তারা।
এ দালাল চক্রের নেপথ্যে রয়েছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল এলাকার বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। সরেজমিনে দেখা গেছে, সাধারণত হাসপাতালের ভেতর ঘোরাঘুরি করেন দালাল চক্রের সদস্যরা। রোগী হাসপাতালে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের পিছু নেন তাঁরা। উন্নত চিকিৎসার নামে তাঁদের ক্লিনিকে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। কেউ কেউ আবার রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ কেনার জন্য ফার্মেসিতেও নেওয়ার চেষ্টা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল জানান, হাসপাতাল থেকে কোনো রোগীকে ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাতে পারলে তারা ওই রোগীর মোট বিলের শতকরা ৩০ ভাগ পেয়ে থাকেন। তা ছাড়া বেশির ভাগ দালালই নিজ নিজ ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ক্লিনিকের জন্য কাজ করে থাকেন। এ ছাড়াও হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক মেশিন থাকা সত্ত্বেও কখনো কখনো চিকিৎসকদের নির্দেশনা অনুযায়ী রোগীদের যেতে হচ্ছে নিম্নমানের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, এমন অভিযোগও তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের আশপাশে গড়ে ওঠা নি¤œমানের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালেরা হাসপাতালে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই কমিশনের ভিত্তিতে এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
২১৮ নম্বর কক্ষে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আবুল হোসেনের কাছে এ দালাল চক্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লালু ও সিরাজ এখানে রোগীর চাপ বাড়লে, তা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। এ ছাড়া তাঁদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তাঁদের রাখিনি। তাঁদের বিষয়ে হাসপাতালের আরএমও সাহেব বলতে পারবেন।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শামীম কবির বলেন, ‘এরা হাসপাতালের কেউ না। ইতিপূর্বে একাধিকবার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াশীমুল বারী তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তারপরও এদের থামানো যাচ্ছে না।’