জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহঃ
প্রতিদিনের মতো রাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল শিশু ইজাহিদ। রাত ১১টার দিকে একটি বিষধর সাপ কামড় দেয় তাকে। ওই সময় শিশুটির চিৎকারে জেগে ওঠেন পরিবারের সবাই। ঘুম থেকে উঠে তারা সাপ দেখতে পান। বুঝতে বাকি থাকে না, ইজাহিদকে সাপে কামড় দিয়েছে। রাতেই স্থানীয় ওঁঝার কাছে নেওয়া হয়। ঝাঁড়-ফুঁক চলে রাতভর। সকালে শিশুটি মারা যায়। মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ১২ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের বাগুটিয়া গ্রামের।ইজাহিদ ওই গ্রামের মানোয়ার হোসেনের ছেলে।
সে বাগুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়তো। এ নিয়ে গত দুই মাসে জেলায় ১২ জন সাপের কামড়ে মারা গেছেন। এরমধ্যে শুধু শৈলকুপাতেই মারা গেছেন ১০ জন। ফলে শৈলকুপার অধিবাসীদের মধ্যে সাপ আতঙ্ক বেশি। সবশেষ ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যারাতে সাপের কামড়ে মারা গেছে শৈলকুপার মলমলি গ্রামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এর আগে ২৯ আগস্ট রাতে জেলার শৈলকুপা উপজেলার দোহারো গ্রামের সাপের কামড়ে শরিফা খাতুন (২৩) নামে সাত মাসের অন্তস্বত্তা এক গৃহবধু মারা যান। তিনি ওই গ্রামের রাশিদুল ইসলামের স্ত্রী।
২৩ আগস্ট রাতে সাপের কামড়ে মারা যায় রাব্বি (৫) ও তাহসিন (৮) নামে দুই শিশু। এদের মধ্যে রাব্বি পৌর এলাকার চতুড়া গ্রামের শুভর ছেলে ও তাহসিন দুধসর ইউনিয়নের নাকোল গ্রামে বিল্লাল হোসেনের ছেলে। ১১ আগস্ট সন্ধ্যায় সাপের কামড়ে মারা যায় শৈলকুপার মনোহরপুর ইউনিয়নের উত্তর পাইকপাড়া গ্রামের আহম্মদ মন্ডল (৪) নামে এক শিশু। ৬ আগস্ট শৈলকুপায় ঘুমন্ত অবস্থায় সাপের ছোবলে মারা যায় জেরিন নামের আড়াই বছরের একটি শিশু। জেরিন হরিহরা গ্রামের আলামিন মন্ডলের মেয়ে।
৫ আগস্ট শৈলকুপার আসাননগর গ্রামে সাপের কামড়ে আব্দুর রশিদ (২২) নামে এক যুবক মারা যান। এছাড়া ১ আগস্ট রাতে জেলার কালীগঞ্জে সাপের কামড়ে জুলিয়া খাতুন নামে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। জুলিয়া উপজেলার ভাতঘরা দয়াপুর গ্রামের জসিম উদ্দিনের মেয়ে। এদিকে, শৈলকুপাসহ বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক সাপের কামড়ে মানুষ মারা গেলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোতে এর চিকিৎসায় কোনো এন্টিভেনম বা প্রতিষোধক ভ্যাকসিন নেই। গেল বছর সব থেকে বেশি সাপের কামড়ে মারা যাওয়া উপজেলা শৈলকুপায় এক সেট এন্টিভেনম দেওয়া হলেও সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় তা জেলা সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
ফলে হাতের কাছে চিকিৎসা সেবা না থাকায় স্থানীয়রা ওঁঝা-কবিরাজের শরণাপন্ন হন। যে কারণে সাপে কাটা রোগীদের বেশিরভাগই মারা যান কার্যত বিনা চিকিৎসা অথবা অপচিকিৎসায়। শৈলকুপার অধিবাসী গণমাধ্যমকর্মী আব্দুর রহমান মিল্টন জানান, গত দুই তিন বছর হলো শৈলকুপায় সাপের কামড়ে মারা যাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। বর্ষা মৌসুম এলেই সাপের উপদ্রব বাড়ে। এবছর ইতোমধ্যে ৯ জন মারা গেছেন। গত বছর এ সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।তার ভাষ্য, সাম্প্রতিক সময়ে এ উপজেলায় ‘শাখাকানন’ বা ‘কালাচ’ নামে পরিচিত সাপের উপদ্রব বেড়েছে।
এ সাপে কামড়ানো ব্যক্তিদের বেঁচে যাওয়ার রেকর্ড খুবই কম। ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডাক্তার সেলিনা বেগম বলেন, ‘আমাদের দেশের যত মানুষকে সাপে কাটে, তার ২০ ভাগ বিষধর। বাকি ৮০ শতাংশ মানুষকে সাধারণ সাপে কামড়ায়। এরমধ্যে অনেকে ভয়ে স্ট্রোক করে মারা যায়। তবে সাপে কামড়ানোর পর চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনলে সহজে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়।’ তিনি বলেন, জেলা সদর হাসপাতালে এন্টিভেনম রয়েছে।
কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সাপে কামড়ানোর পর পরিবারের সদস্যরা প্রথমে কবিরাজের কাছে নিয়ে ঝাঁড়ফুঁক করে সময় নষ্ট করে। একেবারে শেষ পর্যায়ে তারা হাসপাতালে নিয়ে আসে, যখন ডাক্তারদের আর কিছুই করার থাকে না। ফলে সচেতনতার অভাবে প্রায়ই জেলার বিভিন্ন এলাকায় সাপের কামড়ে নারী-পুরুষসহ শিশুরা মারা যাচ্ছে।