চুয়াডাঙ্গা মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদে ভিজিএফ’র চাল বিতরণ নিয়ে উত্তেজনা
পুুলিশ প্রহরায় চাল বিতরণ : বিক্ষোভ মিছিল : প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ
নিউজ ডেস্ক: ভিজিএফ’র চাল বিতরণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়ে মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যানকে লাঞ্ছিতের অভিযোগ উঠেছে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সাংসদ, জাতীয় সংসদের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের বিরুদ্ধে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদরের মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষকলীগের সভাপতি গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার, ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান, আনিছুর রহমান, আব্দুল খালেক, ইউনিয়নের সরিষাডাঙ্গা উত্তর পাড়ার আব্দুর রহমানের ছেলে মিলন মিয়া (৩২), মোস্তফার ছেলে শাহিন (৩০), মৃত. নঈম উদ্দিনের ছেলে তৌহির উদ্দিন (৬০), মৃত. রহমানের ছেলে হুমায়ন (৫০), মৃত. ঠান্ডুর ছেলে জসিম (৩৪), চন্দন (৩২), মৃত. হাতেম আলীর ছেলে হাসেম (৪০) ও মিরাজুলের ছেলে মিঠু (২৮)।
জানা যায়, ভিজিএফ’র চাল বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য হুইপ ছেলুন মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদে আসেন। এরআগে চাল প্রাপ্তির কার্ড বঞ্চিত বিক্ষুদ্ধদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভকারীদেরকে শান্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে চেয়ারম্যান গোলাম ফারুকসহ উল্লেখিত পদস্থ কর্মকর্তাদেরকে নিয়ে ইউপি ভবনের দোতলায় তাৎক্ষণিক জরুরি বৈঠকে বসেন হুইপ ছেলুন। কিছু সময় পর বৈঠক শেষে নীচে নেমে এসে হুইপ ছেলুনের উপস্থিতিতে সদর ইউএনও ওয়াশীমুল বারী ইউনিয়নের কার্ড বঞ্চিত সকল গরীব-দুস্থদেরকে ৫ কেজি করে চাল প্রদানের ঘোষণা দিলে উত্তেজনার নিরসন ঘটে। এর পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে ইউপি কার্যালয়ে মাননীয় হুইপ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইউএনও ও সদর থানার অফিসার ইনচার্জের উপস্থিতিতে চাল বিলি-বন্টন শুরু হয়। এ সময় সদর উপজেলার ট্যাগ অফিসার, মোমিনপুর ইউনিয়নের সকল মেম্বর ও ইউনিয়ন সচিব উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এরআগে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বরাদ্দপ্রাপ্ত ভিজিএফ’র মাথাপিছু ১০ কেজি করে চাল বিলি-বন্টন নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালের দিকে মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার ও স্থানীয় নারী নেত্রী শেফালী খাতুন উভয় পক্ষের লোকজন ও অনুসারীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় শেফালী খাতুন তার কার্ডধারী লোকদের চাল দেয়ার দাবী তুললে মারমুখী ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপি বেলা ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত হন। ওই সময়ে চাল প্রাপ্তির কার্ড বঞ্চিত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিক্ষুদ্ধ গরীব-দুস্থ শত শত মানুষ ভিজিএফ’র চাল বিলি-বন্টনে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও পক্ষ পাতিত্বের অভিযোগে চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল। এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কলিমুল্লাহ, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াশীমুল বারী, সদর থানার অফিসার ইনচার্জ দেলওয়ার হোসেন প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান জিপু পৌছালে আরো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় জিপুর সাথে থাকা লোকজনের সাথে নারী নেত্রী শেফালী গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নেয়। এ সময় স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার সংবাদকর্মীর মোটরসাইকেল ভাংচুর করে বিক্ষুব্ধরা।
বিক্ষোভকারীরা জানায়, চাল বিতরণ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় হুইপ সাহেবের কারণে। তিনি এখানে এসেই বলেন- ‘তুরা চাল নিতে এসেছিস মানে, চাল দেবো আমি, আমার লোকজনকে চাল দেবো’।
চাল বিতরণ নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনার খবর পেয়ে সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (অপারেশন) আমির আব্বাস বিপুল সংখ্যক সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌছে পরিস্থিতি শান্ত করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহা. কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে স্থানীয়দের গোলযোগের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। কিছু সময় চাল বিতরণ বন্ধ থাকলেও পরে পুলিশ প্রহরায় চাল বিতরণ শেষ করা হয়।
ওসি (অপারেশন) আমির আব্বাস বলেন, ভিজিএফ’র চাল দেয়াকে কেন্দ্র করে ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার ও শেফালী খাতুনের মধ্যে গোলযোগ হয়। খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে যায়। পরে আমরা উপস্থিত থেকে চাল বিতরণ শেষ করি। তবে এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কেউ কোন অভিযোগ করেনি।
ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার বলেন, ভিজিএফ’র চাল বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধনের জন্য মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদের আমন্ত্রণ জানানো হয় হুইপ সাহেবকে। কিন্তু হুইপ সাহেব ইউনিয়ন পরিষদে এসেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন এবং তার লোকজনকে কেনো চাল দেয়া হচ্ছে না জানতে চান। উত্তরে আমি বলি- আমিও কৃষকলীগের জেলা সভাপতি, আমারও দলীয় লোকজন আছে। তাই বলে নিয়ম বর্হিভূতভাবে গরিব-দুঃখীদের চাল অন্য কাউকে দিতে পারিনা। এরই একপর্যায়ে হুইপ সাহেব আমাকে চড় থাপ্পড় মারেন। ঠেকাতে গেলে আমার তিন’জন ইউপি সদস্য ও জনগণকে মারপিট করে (হুইপ) তাঁর সাথে থাকা লোকজন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বের করে দেয়া হয় সকল সদস্যসহ মহিলা সদস্যদেরকে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ পাহারায় চাল বিতরণ কার্যক্রম শেষ করা হয়েছে।
নারী নেত্রী শেফালী খাতুন বলেন, আমি হুইপ সাহেবের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে যায়। তা ছাড়া আমাদের সাথে সমন্বয় করে চাল বিতরণের কথা থাকলে কোন প্রকার সমন্বয় ছাড়াই বিএনপি-জামাতের লোকজনকে চাল দিচ্ছিল ফারুক চেয়ারম্যান। শুধু তাই নয়; তার কাজ হচ্ছে ক্যাডারদের কাছে চাল পৌছে দেয়া। বস্তা ভর্তি করে সে চাল নিয়ে যায় ক্যাডাররা। কিন্তু আমাদের দাবি এই চাল যাদের প্রাপ্য তারা পাক। চাল বিতরণের ঘটনা নিয়ে উত্তেজনার খবর সঠিক নয়, এর কিছুই এখানে হয়নি।
এ প্রসঙ্গে হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন বলেন, যে কথা চেয়ারম্যান ও কৃষক লীগের সভাপতি বলেছে তা মিথ্যা। আমি নিজে উপস্থিত থেকে চাল বিতরণ শুরু করেছি।
জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, আমি সকালেই শুনেছি ঘটনা। ঘটনাটি আমাদের জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারের নজরে আছে। স্মারকলিপি অনুযায়ী জেলা প্রশাসন থেকে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে তিনি জানান। সেইসাথে গত বছরের ঈদের সময়ের অপ্রীতিকর ঘটনার কথা বলে তিনি জানান এবার ঈদে যেন শান্তশিষ্ট, সম্প্রীতি, ভালবাসা এবং মিলেমিশে করার আশা ব্যক্ত করেন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ভিজিএফ’র চাল বিতরণে হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের অনৈতিক দাবি বন্ধ ও মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দারকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে জেলা কৃষক লীগ। বিক্ষোভ মিছিলটি শহরের জেলা পরিষদ ডাক বাংলো চত্বর থেকে শুরু হয়ে সদর থানার সামনে পুলিশি বাঁধার মুখে পড়ে। সেখান থেকে ঘুরে মিছিলটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এসে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি পেশ করে। স্মারকলিপি প্রদান শেষে মিছিলটি চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আহ্বান করে। তাৎক্ষণিক এই কর্মসূচীকালে সেখানে কোন সাংবাদিককে না পেয়ে সংবাদ সম্মেলন ছাড়ায় বিক্ষোভ কর্মসূচী শেষ হয়। তবে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান না হলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারী দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু, বাংলাদেশ ইউপি চেয়ারম্যান সমিতির চুয়াডাঙ্গা জেলা সভাপতি ও চিৎলা ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান, জেলা কৃষকলীগের সভাপতি ও মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার, জেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কবির, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জানিফ, যুগ্ম সম্পাদক জাকির হুসাইন জ্যাকীসহ আরো অনেকে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে শান্ত চুয়াডাঙ্গাকে অশান্ত করে তুলেছেন এবং সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুন্ন করে চলেছেন। বৃহস্পতিবার সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদে ভিজিএফ’র চাল বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধনের কথাছিল তাঁর। সকাল ১০ নাগাদ ইউনিয়ন পরিষদে এসে পৌছান তিনি। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যান চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষকলীগের সভাপতি ও মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দারসহ পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা। এ সময় হুইপ ছেলুন আকস্মিক চেয়ারম্যান ফারুককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন ও তার গালে চড় মারেন। ঘটনার সময় উপস্থিত ইউপি সদস্যরা হুইপের হামলা থেকে চেয়ারম্যান ফারুককে রক্ষা করতে এগিয়ে এলে হুইপের সাথে থাকা লোকজন ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান, আনিছুর রহমান ও স্থানীয় জনতা মিলন মিয়াকেও বেদম প্রহার করে।
স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, ঈদের পূর্ব মুহূর্তে গরীব মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ভিজিএফ’র চাল বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধনের পরিবর্তে চেয়ারম্যানকে চড় মারাসহ তার সেচ্ছাচারিতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে সরকারের ত্রাণ বিতরণ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে চুয়াডাঙ্গার গরীব, দুঃখী, সাধারণ মানুষ। সে কারণে চুয়াডাঙ্গাবাসী মনে করে এমন পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গার উন্নয়ন ও ত্রাণ বিতরণে হুইপ ছেলুনের সকল ধরণের হস্তক্ষেপ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
হুইপ ছেলুনকে জেলার সকল উন্নয়ন ও ত্রাণ কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা ও ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক জোয়ার্দ্দারকে লাঞ্ছনার ঘটনায় উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিকট দু’দফা দাবি করা হয়।