কৃষি ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ দেখাচ্ছে সম্ভাবনার পথ
নিউজ ডেস্ক:সারা দেশে যখন পেঁয়াজের মূল্য আকাশচুম্বী, ঠিক তখন পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ দেখাচ্ছে সম্ভাবনার পথ। এ দেশে সাধারণত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের সংকট দেখা দেয়। ফলে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট বারি-৫ পেঁয়াজের চাষে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ চাষ করে ইতিমধ্যেই কৃষকেরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ২০১৭ সালের ৮ মার্চ থেকে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে কৃষকেরা বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ চাষ করে ভালো ফলন পাওয়ায় খুশি। ফলে অধিকাংশ কৃষকের মধ্যে বারি-৫ পেঁয়াজ চাষে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আগামীতে বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ চাষ করে কৃষকেরা আরও বেশি লাভবান হবেন বলে আশা করছে মুজিবনগর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। মুজিবনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান খান জানান, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) আর্থিক সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশন ‘ বছরব্যাপী পেঁয়াজ উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অসছে। এ প্রকল্পের আওতায় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ১ হাজার ৫০০ কৃষককে উন্নত ব্যবস্থাপনায় সারা বছরব্যাপী পেঁয়াজ চাষবিষয়ক দুই দিনের দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ প্রশিক্ষণের ফলে কৃষকেরা পেঁয়াজ উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সুষম সারের ব্যবহার, সেচ, বীজ, পেঁয়াজ সংরক্ষণ এবং রোগ ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জানতে পারেন। জানা গেছে, এ বছর কৃষকেরা উন্নত প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহার করে বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ চাষ করেছেন। মুজিবনগর সোনাপুর গ্রামের মৃত ফরমান ম-লের ছেলে কৃষক মো. আল আমিন জানান, ‘গত চার বছর ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ জাতের পেঁয়াজের চাষ করে কাঠাপ্রতি ৭ মণ হারে ফলন পেয়েছি।’ এ ছাড়া মুজিবনগর জয়পুর গ্রামের ফকির মাহমুদের ছেলে মোফাজ্জেল হোসেন, সিরাজুল ইসলাম ও সরোয়ার হোসেনের ছেলে আঙ্গুর আলী বলেন, ‘এ বছর গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ জাতের পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করছি। এ বীজ দিয়ে আগামী গ্রীষ্মকালে প্রায় ৯ বিঘা জমিতে চাষ করব। এ বছর পেঁয়াজ উৎপাদন করেছিলাম ১০০ মণ। ভালো দামে বিক্রি করেছি।’ বাগোয়ান ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের কৃষক আলামিন বলেন, ‘ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নিকট হতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১০ কাঠা জমিতে গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ চাষ করে ১৬ হাজার টাকা লাভ করেছি।’ জানা গেছে, ইতিমধ্যে ৮৭৫ জন কৃষক এ বছর বারি-৫ পেঁয়াজ চাষের ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কৃষিবিদ নাসির উদ্দিন জানান, বাংলাদেশে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা অর্থাৎ সারা বছর এ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ করা সম্ভব। আগাম চাষের জন্য মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। নাবি চাষের জন্য জুলাই থেকে আগস্ট মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। ৩৫-৪০ দিনের চারা মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। ৭ শ ৫০ থেকে ১ হাজার মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় এমন স্থানে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ভালো হয়। সব রকম মাটিতেই পেঁয়াজের চাষ করা যায়, তবে সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত বেলে দোঁ-আশ বা পলিযুক্ত মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। মাটির অম্লতা (পিএইচ) ৫.৮-৬.৮ হলে ভালো হয়। প্রতি বীজতলায় ২৫-৩০ গ্রাম হিসাবে প্রতি হেক্টরে ৩-৪ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। রোপণের ৩-৪ সপ্তাহ পূর্বে জমিতে হালকা গভীর (১৫-২০ সেন্টিমিটার) করে ৪-৫টি চাষ দিতে হয়। পেঁয়াজের জন্য প্রস্তুত করা জমির মাঝে মাঝে নালা রেখে ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করা হয়। ব্লকে ৩৫-৪০ দিন বয়সী সুস্থ চারা ১০-১৫ সেন্টিমিটার (এক সারি থেকে আরেক সারি) ও ৮-১০ সেন্টিমিটার (এক চারা থেকে আরেক চারা) দূরত্বে এবং ৩-৪ সেন্টিমিটার গভীর গর্তে ১টি করে রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের পর সেচ দিতে হয়। সারের প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি জানান, শেষ চাষে হেক্টরপ্রতি গোবর বা কমম্পোস্ট ৫ টন, ১৫ কেজি ইউরিয়া, ২০০ কেজি টিএসপি ও এমওপি ১৭৫ কেজি প্রয়োগ করা হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া হেক্টরপ্রতি ৭৫ কেজি ইউরিয়া, ৩৭.৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়। মৌসুম অনুযায়ী পেঁয়াজ চাষ করলে ৭০ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে এবং নাবি চাষের ক্ষেত্রে ৯৫-১১০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। সময় মতো সেচ ও সার প্রয়োগ করা হলে হেক্টরপ্রতি ২০-২৫ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় বলে নাসির উদ্দিন জানান। মুজিবনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান খান বলেন, দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় হেক্টরপ্রতি ৮ মেট্রিক টন। এ ক্ষেত্রে বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ (গড় উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১২ মেট্রিক টন) চাষ করা হলে সমপরিমাণ জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। আনিসুজ্জামান খান আরও জানান, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক পরামর্শে এবং ওয়েভ ফাউন্ডেশনের ‘বছরব্যাপী পেঁয়াজ উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি’ ভ্যালু চেইন প্রকল্পের সহযোগিতায় পেঁয়াজ চাষ করে কৃষকেরা ভালো ফলন ও বেশি দাম পাওয়ায় আনন্দিত। এ প্রকল্প চালু থাকলে পরবর্তীতে পেঁয়াজ চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন আরও বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।